মঙ্গলবার, ১০ ফেব্রুয়ারী, ২০১৫

'লজ্জা' ~ সুশোভন পাত্র

​'লজ্জা' ! আর এই 'লজ্জা' নিয়েই পড়েছি মহাফাঁপরে ! গত কয়েকদিন ধরেই দোকানে, হাটে-বাজার, রাস্তা-ঘাটে সর্বত্র হন্যে হয়ে খুঁজে বেড়াচ্ছি, যেকোনো মূল্য দিতেও প্রস্তুত, কিন্তু কোথাও দেখছি 'লজ্জা' কিনতেই পাওয়া যায় না। গাছেও ধরে না 'লজ্জা' ! মাটি খুঁড়েও পাওয়া যায় না 'লজ্জা' ! বিদেশ থেকে আমদানিও করা যায় না 'লজ্জা' ! সমস্যাটা গভীর।

ফ্লিপকার্ট, স্ন্যাপডিল, জাবং, মিন্ত্রা এরকম দস্তুর অনলাইন সাইটে শুনেছি নাকি কেঞ্জাকুড়ার গামছাও পাওয়া যায়, বিভিন্ন সময়েই বিশেষ ছাড়ের ব্যবস্থাও থাকে। কদিন আগে চিরুনি তল্লাসি করলাম। সার্চ অপশেনে গিয়ে গোটা গোটা অক্ষরে বাঙলায় লিখলাম "১০০ গ্রাম লজ্জা"। পাতি ইংলিশে জবাব এলো "No matching products available." বাধ্য হয়ে গেলাম একটা শপিং মলে। খুঁজে খুঁজে ওঁদের সেলএক্সিকুইটিভ কে জিজ্ঞেস করলাম "দাদা লজ্জা কত কেজি?" শুনে সে তো এক বারে রেগে খাপ্পা। জানেন কি বলল ? বলল "লজ্জা খুঁজে আপনি এখানে এসেছেন ?এক্ষুনি 'মল ত্যাগ' করুন না হলে পুলিশ ডাকবো কিন্তু।" মনের দুঃখে মল ত্যাগ করলাম, বেরিয়ে আসতেই চোখে পড়ল পান-বিড়ি-সিগারেটের দোকানে লেখা "ধার চাহিয়া লজ্জা দেবেন না ।" জয়গুরুর নাম করে সটান দোকানে ঢুকে বললাম "দাদা ধারে একটা গোল্ড ফ্লেক দিন তো। আর দয়া করে আপনি যে লজ্জাটা পাবেন ওটা আমাকে দিন। যা দাম চান দেবো।" শুনে ভদ্রলোক এমন ভাবে তাকালেন যেন গিলেই ফেলবেন। উফ! শেষে গেলাম এক বইয়ের দোকানে বললাম "দাদা লজ্জা আছে?" " বললেন "হ্যাঁ। আছে। ক-কপি চান ?" যেই আমি বললাম " মানে, কেজি দরে পাওয়া যায় না দাদা ?" দিলেন দোকান থেকে ঘাড় ধাক্কা ! ভাবুন একবার !

ছোটবেলার এক বিকেলে তবলার শেখানোর মাস্টারমশায় কে বসিয়ে রেখে, বাথরুম যাবার নাম করে পিছনের দরজা দিয়ে খেলতে চলে গিয়েছিলুম, ফিরে আসার পর মা বলেছিল "তুই এটা করতে পারলি ? এতটুকু লজ্জা লাগলো না তোর ? জীবনে তুই তবলা শিখতে পারবি না, দেখিস।" সেদিনই বুঝেছিলাম 'লজ্জা' হল লাগার 'বস্তু'। মায়ের ভবিষ্যৎ বানী পাই টু পাই মিলে আমার তবলার ভবিষ্যৎ অচিরেই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলেও 'লজ্জা' আমি পেতে শিখেছিলাম। যখন জানলাম গাছের প্রাণ আছে প্রমান করা যায় লজ্জাবতী লতা ছুঁয়ে, বুঝলাম 'লজ্জা' প্রাণের একটি সুন্দর আবেগ। আবার যখন শুনলাম 'লজ্জা নারীর ভূষণ'। তখন ভাবলাম তাহলে পুরুষ মাত্রই বোধহয় 'বি-ভূতি-ভূষণ'। কিছুদিন আগে লোকে বলছিল "VC'র গণ্ডারের চামড়া ! লজ্জা নেই।" বুঝলাম গণ্ডারের বোধহয় 'লজ্জা' নেই তাহলে। মামাবাড়ি গেলেই দিদা বলত "খাওয়ার সময় লজ্জা করতে নেই "। বুঝলাম খেতে বসার আগেই 'লজ্জার' মাথা চিবিয়ে খেতে হয়। দিদার কথা এখনও শিরোধার্য। কিন্তু তসলিমা'র আবার বিখ্যাত 'লজ্জা' আছে। ভারতের ক্রিকেট টিমও বিদেশে মাটিতে সময় অসময়ে ভালোবেসে আমাদের অনেক 'লজ্জাই' দেয়, জার্মানি নাকি এ বারের বিশ্বকাপে ব্রাজিল কে শ্রেষ্ঠ 'লজ্জা' উপহার দিয়েছে , বলিউডে মাধুরী দীক্ষিতের 'লজ্জা' একসময় বক্সঅফিস কাপিয়েছে। রবীন্দ্রনাথ তো কবেই লিখে গিয়েছেন "...প্রাণ চায় চক্ষু না চায়,/মরি একি তোর দুস্তর লজ্জা..." মোটকথা পৃথিবীতে ম্যাদামারা ভদ্দরলোক যেমন নিজের মতো করে লজ্জা পায়, বোদা গামবাট লোকেরও তাদের মতো করে লজ্জা পায়।

আসলে লজ্জার সাথে আত্মসম্মান, আত্মবিশ্বাস, বিবেক, বুদ্ধি, মর্যাদা, মান, হুশের, অঙ্কের ভাষায় একটা 'সমানুপাতিক' সম্পর্ক আছে। এসব থাকলে আপনি ভুল করলে, অন্যায় করলে, নিজের স্বার্থ লাভের জন্য অন্য কে বঞ্চিত করলে, প্ররোচিত করলে লজ্জা পাবেন। লজ্জিত হবেন। আর এসব এর সঙ্গে আপনার সম্পর্ক ব্যস্তানুপাতিক হলে, বিবেক, বুদ্ধি, মান মর্যাদা, বিক্রি করে নির্লজ্জ হয়ে, মুখে রং মেখে, সানগ্লাস পরে সং সেজে, রাস্তায় রাস্তায় 'পরিবর্তন চাই পরিবর্তন চাই' করে মাস দু -এক টানা কেত্তন আর ঢং করে সঠিক সময় কর্পূরের মত উবে যেতে পারলেই... তবেই, একমাত্র তবেই আপনি 'বুদ্ধিজীবী'।

ঠাকুর তো কবেই বলে গেছেন 'ইষ্টলাভের' জন্য , লজ্জা, ঘৃণা, ভয় -- তিন থাকতে নয় ...

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন