কোলকাতা থেকে গাড়িতে সিঙ্গুরের রাস্তা গুগল ম্যাপে দেখায় দুর্গাপুর এক্সপ্রেসওয়ে দিয়ে। যে সময়ের কথা বলছি, তখন ২০০৮ এর সেপ্টেম্বর মাস।পুরো দেশ, হুগলির সিঙ্গুরের দিকে তাকিয়ে, জমি আন্দোলন তুঙ্গে। ন্যাশানাল হাইওয়ে অবধি যখন তখন বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। শয়ে শয়ে ট্রাক চুপচাপ দাঁড়িয়ে, এখানে ওখানে টায়ার পোড়ানো, রাস্তায় বিভিন্ন জায়গা আটকে, যে পারছে শুয়ে-বসে পড়ছে।বোম্বে রোডের ঝামেলা বাইপাস করে সিঙ্গুরে আসার অন্য রাস্তা হচ্ছে জিটি রোড ধরে সোজা শেওড়াফুলি- বৈদ্যবাটী, সেখান থেকে তারকেশ্বর রোড। এভারেস্টের যেমন বেস-ক্যাম্প হয়, তেমনি স্ট্যালিনগ্রাদ সিঙ্গুর যাবার বেস-ক্যাম্প হলো শেওড়াফুলি।
ফাঁড়ির মোড়ে, বৈদ্যবাটী চৌমাথায় আকছার ইটিভি বা আজতকের গাড়ি দাঁড়িয়ে। গলায় ব্যাজ ঝুলিয়ে রিপোর্টার পরোটা খাচ্ছে, কোল্ড ড্রিঙ্কস কিনছে।ফাস্ট-ফুডের দোকানের বেঞ্চে খদ্দরের পাঞ্জাবী, লিনেন শাড়ি, অক্সিডাইজড জুয়েলারি পরা বিপ্লবীদের দল। শান্তিতে গোল্ডফ্লেক কিংসটা শেষ করে, পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে যোগ দেবেন। প্রণয় রায় ন্যাশানাল টেলিভিশানে বললেন, মনে রাখবেন, হুগলীর এই ছোট্ট গ্রাম ঠিক করে দেবে জমির অধিকার কার! এরকম আনন্দমেলার কমিকস পড়তাম, এস্টেরিক্স-ওবেলিকস, গলেদের ছোট্ট গ্রাম, রোমানরা ঘিরে ফেলেছে, কিন্তু এই গ্রাম লড়ছে। সিঙ্গুরও তাই, চারিদিকে লোভী বুর্জোয়ারা জিতে গিয়ে কোকা-কোলা খাচ্ছে। বিবেক হয়ে দাঁড়িয়ে আছে একা সিঙ্গুর, এযুগের লেনিন সাদা শাড়ি পরে ধর্নায় বসে।
এনডিটিভির রিপোর্টার সেদিন যেখানে দাঁড়িয়ে ন্যাশানাল টেলিভিশানে লাইভ এসেছিলো, সেটা সিঙ্গুর ছিলো না, শেওড়াফুলি ছিলো, চৈতালি সঙ্ঘ ক্লাবের সামনে।তার পাশে আমরা আড্ডা মারতে যেতাম। আমার এক বন্ধু আজো দাবী করে ন্যাশানাল টেলিভিশানে তাকে দেখিয়েছিল, স্ট্যালিনগ্রাদ সিঙ্গুরে ক্যাপিটালিস্টদের চোখে চোখ রেখে, সে হাফপ্যান্ট পরে বিড়ি খাচ্ছে।অক্টোবরের ৩ তারিখ, ২০০৮, দিনটা স্পষ্ট মনে আছে। সেদিন রতন টাটার কলকাতায় প্রেস কনফারেন্সে টাটাদের পাততাড়ি গোটানো কনফার্ম হয়েছিলো।
স্টেশান থেকে বেরিয়ে ওষুধের দোকানে দাঁড়িয়েছি যখন, দেখি জিটি রোড বন্ধ করে বিজয় মিছিল হচ্ছে। মিছিলের শেষে একটা রিকশায় লাল ভেলভেটের জামা পরে একটা ছেলে কীবোর্ডে "সাত সমুন্দর পার ম্যায় তেরে পিছে পিছে আ গ্যয়ি' বাজাতে বাজাতে যাচ্ছে, সামনে ড্রাম বাজাচ্ছে আরো কয়েকটা লাল ভেলভেট। ব্যাঞ্জো থেমে গেলে, মাইকে ঘোষণা হয় আর কিছুক্ষণের মধ্যেই সিঙ্গুর থেকে শেওড়াফুলি আসছেন মহাশ্বতা দেবী, মেধা পাটেকার সবাই। উত্তেজনা তুঙ্গে। শেষ সেলেব নাম ঘোষণা হয়, অপর্ণা সেন। মিছিলের জনতা ফুটছে পাগলা আনন্দে, মনে হচ্ছে দ্বিতীয় স্বাধীনতা দিবস।
সেই নাম ঘোষণার পরেই সেদিন শনি-মন্দিরের সামনে ফলের দোকানদার তপাদাকে ফেলে পেটানো হয়, ছোট্ট ঘটনা বলতে পারেন। বিপ্লবে তো তাই হয়, বুর্জোয়া মার খায় ইত্যাদি প্রভৃতি। বড় পিয়ারা আর নাসপাতিগুলো তপাদার দোকানে সাদা ফোমের নেটে জড়ানো থাকতো। মেরে যখন তপাদার মাথাটা ড্রেনে ঢুকিয়ে দিয়েছে, জল থেকে বিজগুড়ি কাটছে শ্বাসটুকু, তপার মাথার পাশেই ড্রেনের জলে ক্যাম্বিস বলের মতো ভাসছে ইয়া বড়ো বড়ো পিয়ারা। রিকশার লাল ভেলভেটের জামা বাজাচ্ছে, 'ও জুলফি মেরী জাআন, তেরে কাদমো কে নীচে আ গাই, ও ও সাত সমুন্দর...'। মেধা পাটেকার, মহেশ্বতা দেবী সেদিন আসেননি। অপর্ণা সেনও না। আসার কথাও ছিলো না মনে হয়।
পরের দিন শাসক, মানে তখনকার শাসক, সভা করে বলেছিলো, আমরা জবাব দেবো, ভুলবো না একদম, এইসব আরকি। যিনি বলেছিলেন, তিনি একমাস পরে দলবদল করেন। ভদ্রলোক বলতেন ভালো। বিরোধী দলে, মানে তখনকার আরকি, গিয়ে গ্রামীণ সাবঅলটার্ণদের উত্থান, ভদ্দরলোকেদের এলিটিজমের পতন, উচ্চবর্ণের বাবুদের উঁচু-নাক তিনি দেখেছেন, এসব বলতেন। হাততালিও পেয়েছেন মন্দ না। সেইদিনটার তেরো বছর পর, ৩১শে জানুয়ারী, ২০২২, রাজ্য সরকার সিঙ্গুরের জমিতে মাটি কেটে ভেড়ি বানিয়ে চারাপোনা চাষের সিদ্ধান্ত নেয়।
জানি না এই লেখা কি করে শেষ করবো, কথায় কথা আসে হইহই করে। ফেসবুকে এরকম লেখা মুশকিল, ফেসবুক বড় লেখার জায়গা না। এই লেখাতে কোন গন্তব্য নেই, এইরকম বহমান লেখা ফেসবুকের পোলারাইজড স্পেকট্রামে দাঁড়াতে পারে না। সোশ্যাল মিডিয়া এনগেজমেন্টে বেঁচে থাকে। কিন্তু সবদিন একটা শোম্যানশিপ, প্লেয়িং টু দ্য গ্যালারি থেকে লেখা আসে না, কিছু লেখা শুধুই কথা বলার জন্য। যেটা বলে শেষ করি, তপাদার ছেলে পলিটেকনিক করে বাইরে থাকে জানতাম। কাল পাড়ার হোয়াটসয়াপ গ্রুপে জানলাম মুম্বাইয়ের অটল সেতুর কাজে যুক্ত ছিলো বেশ কয়েকবছর। আর নিতান্ত কাকতালীয় ভাবে, কদিন আগেই দেখলাম, সেই জ্যেঠু পোস্ট দিয়েছেন ইউক্রেন না প্যালেস্টাইন কোথায় একটা অত্যাচারের বিরুদ্ধে, ক্যাপশানে, মানুষের এতো কষ্ট ...সব ইয়াদ রাখ-খা জায়গা।
না হে জনাব, কিছুই কেউ ইয়াদ রাখে না, ওরকম শুধু বলতে হয়, শুধু আমাদের বয়স বেড়ে যায়। কারুর ছেলে ব্রিজ বানায়, বন্দর বানায়। কেউ মাছের ভেড়ি আর চব্বিশ পরগণায় বাগানবাড়ি কিনতে থাকে, কিনতেই থাকে। আর আমি ১৫টা বছর পার করে হাসির গল্প লিখতে বসি।সোফায় বাদামী চশমা পরে বিবেক সেজে অপর্ণা সেনকে এনে বসাই। সেদিনের মতো, আজো ওনার আসার কথা নয়, তাও আসতে বাধ্য হন।
আমি দেখি আমার টাইমলাইন জুড়ে মানুষ হাসছে, হাসতেই থাকছে।
সব রম্য নির্মল নয়। কিছু রম্য ব্যঙ্গ।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন