রবিবার, ২১ জানুয়ারী, ২০২৪

লেনিন কে নিয়ে কুৎসা ~ ডঃ সমুদ্র সেনগুপ্ত

কুৎসা প্রচার টা কেউ কেউ আর্টের পর্যায়ে নিয়ে গেছে। আর সুলভ ইন্টারনেট ও গুগল বাবার দৌলতে এই উত্তর সত্য কালে কোনটা যে সত্যি আর কোনটা যে মিথ্যে সেটা ধরাও মুশকিল। আজকের দিনেও দেখলাম লেনিনের মারা যাওয়া নিয়ে সেই কুৎসা অব্যাহত। লেনিন নাকি সিফিলিসে মারা গেছিলেন। এই জাতীয় বক্তব্য পশ্চিমা গণমাধ্যমে অনেক সাংবাদিক, গবেষক, ঐতিহাসিক নানান সময়ে হাজির করেছেন এমনকি ইজরায়েল এর তিনজন ডাক্তার একটি প্রবন্ধও লিখে ফেলেছেন বৈজ্ঞানিক জার্নালে। এসব থেকে উৎসাহিত হয়ে আমাদের দেশেও একটি রাজনৈতিক দলের নেতা কর্মীরা বলে থাকেন যে "সিফিলিস"!! "যৌনরোগ"!! এমনকি সেই যৌনকর্মীর নাম অবধি বের করে ফেলেছেন কেউ কেউ। যথারীতি হোয়াটস এপ, ফেসবুক টুইটারে এসব গল্প ঘরে। এর একটা ফ্যাক্ট চেক দরকার। 

১৯১৮ এর তিরিশ আগস্ট ফানি কাপলান লেনিনকে লক্ষ্য করে তিনটি গুলি চালান। ব্রাউনিং পিস্তলের একটি বুলেট লেনিনের কোটের মধ্যে দিয়ে চলে যায়, একটি বুলেট লেনিনের বাম কাঁধে লাগে, তৃতীয় বুলেটটি লেনিনের গলার বাম দিক দিয়ে বাম ফুসফুসে প্রবেশ করে বেরিয়ে এসে ডান কলার বোন এ আটকে যায়। প্রচুর রক্তপাত হলেও গুলির আঘাতে লেনিন মারা যান নি। গুলি চালানো পরে লেনিনের অপারেশন হয়।

ওই হত্যা প্রচেষ্টা মামলার একজন সাক্ষীর বয়ান অনুযায়ী বুলেটগুলো বিষ মাখানো ছিল। থাকতে পারে, কিন্তু ফরেনসিক মেডিসিন অনুসারে ওই হাই টেম্পারেচারে ওই বিষ এর যা কেমিক্যাল চেঞ্জ হবে তাতে ওটা কাজ করার কথা নয়, করেও নি, লেনিনের শরীরে বিষক্রিয়ার কোনও লক্ষণ ছিল না। 

লেনিনের উপসর্গ শুরু হয় ১৯২১ সালে - মাথাব্যাথা, অনিদ্রা, মাঝে মধ্যে মাথা ঘুরে পরে যাওয়া। গোর্কিকে চিঠিতে লেনিন লিখছেন, "খুব ক্লান্ত লাগে। কিছুই করতে ইচ্ছে করে না।" 

২২শে এপ্রিল বিঁধে থাকা বুলেট বের করার জন্য লেনিনের অপারেশন হয়। এর পরে ১৯২২ সালের ২৬শে মে লেনিন প্রথমবারের জন্য স্ট্রোক বা মস্তিষ্কের পক্ষাঘাতে আক্রান্ত হন। এফাসিয়া ও রাইট হেমিপ্লেজিয়া হয়। লেনিন আস্তে আস্তে সেরে ওঠেন। এর পরেও লেনিনের আরো দুটি স্ট্রোক হয় - ১৯২২ এর ডিসেম্বর ও ১৯২৩ এর মার্চ। শেষ পর্যন্ত লেনিন মারা যান ১৯২৪ এর ২১শে জানুয়ারি। 

বুলেট এর আঘাত নয়, লেনিন এর মৃত্যুকে ঘিরে যাবতীয় বিতর্কের মূলে ওই স্ট্রোক বা মস্তিষ্কের পক্ষাঘাত। এই পক্ষাঘাত এর কারণ খুঁজতে গিয়ে কেউ কেউ এই তত্ত্ব হাজির করেন যে ওই কারণটা হল সিফিলিস বা নিউরোসিফিলিস। এই তত্ত্বের মস্তবড় ফাঁক এটাই যে লেনিন যদি সত্যি সত্যি সিফিলিসে আক্রান্ত হতেন তাহলে শুধুমাত্র মস্তিক নয়, লেনিনের অন্যান্য অংঙ্গও ক্ষতিগ্রস্ত হতো। লেনিনের হৃদযন্ত্র বা হাড়ে সিফিলিস এর কোনও চিন্হ পাওয়া যায় নি। 

এই বিভ্রান্তির জন্য অপপ্রচারই কেবল দায়ী নয়, লেনিনের নিজের কিছু চিকিৎসকও দায়ী। ওই "অল্পবয়সে" লেনিনের স্ট্রোক হওয়ার কথা নয়, লেনিন ধূমপান করতেন না, মদ্যপান পরিমিত, হরমোনের কোনো অসুখ ছিল না, যথেষ্ট শক্ত সমর্থ ছিলেন ওভারওয়েট ছিলেন না, তাঁর সেরিব্রাল আর্টারিতে অমন পরিবর্তন হওয়ার কথা নয়, তাই ডায়াগনোসিস হিসেবে কেউ কেউ নিউরোসিফিলিস এর কথা ভেবেছিলেন এমন কি সেই মতো চিকিৎসাও করেছিলেন। 

পরে প্রমাণিত হয়েছে যে রোগটা সিভিয়ার আথেরোস্ক্লরসিস। ধমনীতে পরিবর্তন, বিশেষ করে মস্তিষ্কের ধমনীতে। এই পরিবর্তন এতটাই ছিল যে অটোপসির সময়, সার্জেন বলেছিলেন যে ফরসেপস লাগাতে "ধাতব আওয়াজ হচ্ছে।" লেনিনের পারিবারিক হিস্ট্রিও আছে। একই রোগে ৫৪ বয়সে লেনিনের বাবাও মারা যান, আরো তিন ভাইবোন মারা যান। তাই জিনগত কারণেই অপেক্ষাকৃত অল্প বয়সে লেনিনের ওই অসুখ হয়েছিল। তাতেই উনি মারা যান। 

এতদিন আগে মৃত এই বিপ্লবী এখনও বহু দক্ষিণ পন্থীদের হাড় মজ্জায় আতঙ্ক তৈরি করে। তাই লেনিনের সুনাম ধ্বংস করার এত আয়োজন। আমরা যদি একটু সজাগ থাকি তাহলে যে যেখানে পারি যেভাবে পারি এই চক্রান্তের প্রতিবাদ আমরা করতে পারি। লেনিন অমর হয়ে থাকুন আমাদের মননে। 

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন