শুক্রবার, ১ ডিসেম্বর, ২০২৩

পুরনো লেত্তি পুরনো লাট্টু ~ সংকলন সরকার

সে অতি অদ্ভুত বিদঘুটে ভূতুড়ে জায়গা বাপরে বাপ! সাত সক্কাল বেলা ঘুম ভেঙ্গে গেলেই খিদে পেয়ে যায়। বরং বলা ভালো অত সকালে খিদের চোটেই ঘুম ভাঙ্গে! খিদে পেলে হাতের কাছে কিছু না থাকলে চাদর দিয়ে নিজেকে মুড়ে নিয়ে হালকা কুয়াশা ঠেলে গুটি গুটি হেঁটে পৌঁছে যাও থানার পাশে পাঁড়েজীর চায়ের দোকানে। শীত এখানে ভালই পড়ে গেছে। এই সকাল সাড়ে ছটার সময় পাঁড়েজীর দোকানে গরমা গরম চা ছাড়া আর কিছুই গরম পাবে না। কিন্তু খিদে পেয়ে গেছে যে...! একটু মাথা ঘোরালে দেখবে দোকানে মোটে তিন রকমের বিস্কুট আছে, একটা কাচের ঘেরাটোপে গুটিকয় গতকাল সন্ধ্যেবেলার বানানো শিঙ্গাড়া আর গতকাল বিকেলের বানানো জিলিপি। সারারাতের ঠাণ্ডা খেয়ে সে সব খাদ্যবস্তুর গায়ে জমাট ডালডার সাদা পরতের কারুকার্য্য! প্রথম দর্শনে মনে মনে তলপেট থেকে একটা কাল্পনিক চোঁয়াঢেঁকুর খাদ্যনালী বেয়ে উঠে আলজিভের তলায় ঘুরপাক খেতেই পারে। হাজার হোক বাংলার মাটি বাংলার জল বাংলার বায়ু বাংলার ফল খাওয়া পেট তো! কিন্তু বাস্তব ঘটনা আরো খারাপ। সেটা হল পেটের বেসমেন্ট থেকে পেটের টপ ফ্লোর অবধি এখন কম করে খান কুড়ি ছুঁচো দৌড়চ্ছে! তাই আর ডালডার আর্টওয়ার্ক না দেখে ঐ বাসি শিঙ্গাড়া আর জিলিপিই সই। চোখ কান বুজে খেয়েই নেওয়া যাক আপাতত। পরের কেস নাহয় পরে সাল্টে নেওয়া যাবেখন! 

পাঁড়েজীর লোক এখন সবে খোসা সমেত আলুর তরকারীর মালমশলা কেটে বীর বিক্রমে আটা মাখতে লেগেছে। গরমাগরম পুরি তরকারী পেতে পেতে কমকরে আরো ঘন্টা দেড়েক দেরী। সকাল আটটা সোয়া আটটার আগে কোনো মতেই নয়! এখন দেড় ঘন্টা অপেক্ষা করলে ছুঁচোগুলো সংখ্যায় বেড়ে খান চল্লিশেক হয়ে গিয়ে ছুটোছুটি করে পেট ফুটো করে দিতে পারে। অতএব ছুঁচোগুলোকে ঐ আগের দিনের গোটাচারেক করে ডালডা জমা ঠাণ্ডা বাসি শিঙ্গাড়া জিলিপি খাইয়েই ঠাণ্ডা করে দাও আপাতত। তারপর ছোটো কাচের গেলাসে গরম চা দু' হাতের তালুর মধ্যে নিয়ে আয়েশ করে ছোটো ছোটো চুমুকে শেষ করে আবার গুটি গুটি হেঁটে ফিরে আসা যাক নির্ভেজাল ভূতেদের আড্ডার জন্য বিখ্যাত লালকোঠিতে। এবার এটা ওটা খুটখাট করতে করতে সকালের কাজকম্মো গুলো সেরে নেওয়ার পালা, আমাদের কাজ বলতে সামান্যই। দাঁতমাজা, দাড়িছাঁটা বড়বাইরে ইত্যাদি বাথরুমের কাজ মূলত। এ ছাড়া বেড়াতে এসে তোমার আর কাজ কী! 

অদ্ভুত রকমের রুক্ষ অথচ সতেজ প্রকৃতি শিমুলতলায়। এখানকার লোকজনদের জীবনযাপন আরো অদ্ভুত... কিছুটা সপাট সতেজ কর্মঠ সময় দেখার পরেই দেখতে পাবে, এখানে আর কোনো কাজ নেই। সব কাজ শেষ হয়ে গিয়েছে... অতএব আবার যেদিকে তাকাবে দেখবে আলস্য বাবাজী সবখানে চাদর বিছিয়ে ঠ্যাং ছড়িয়ে বসে আছে। ভাবখানা এই... আয় আয়, আয় এবার একটু চুপটি করে আমার দালানে ঠেস দিয়ে বোস দিকিনি... হুশহুশিয়ে অনেক কাজ তো করলি রে বাপ, এখন আমায় একটু শান্ত হয়ে বল তো দেখি কী কী কাজ করলি এতক্ষণ ধরে অত হৈহল্লা করে?! তো, এই সব ভাবতে ভাবতে প্রায় পৌনে আটটা বেজে যাবে, আর আমরা আবার প্রচণ্ড অবাক হয়ে খেয়াল করব যে জানলা দিয়ে একটা মন উদাস করা মৌরীফোড়োন দেওয়া খাবারের সুগন্ধ আসছে। সেটা সম্ভবত পাঁড়েজীর দোকানে আলুর তরকারী রেডি হয়ে যাওয়ার গন্ধ... এইবার এক কড়াই গরম তেলে আটার লাল লাল পুরি ভাজা হবে! এবং আরো ভয়ানক অবাক হয়ে আমরা খেয়াল করব, পেটে গোটাপাঁচেক ছুঁচো নড়াচড়া শুরু করেছে! কোলকাতা বা তৎসংলগ্ন অঞ্চলে থাকলে কিন্তু ওই একগন্ডা বাসী শিঙ্গাড়া আমাদের বিকেল পাঁচটা অবধি খিদে পাওয়া থেকে বিরত করে রাখতে পারত। কিন্তু আমরা এখন বাড়িতে নেই... তাই এবার একটা হাফ সোয়েটার চাপিয়ে গুটি গুটি আবার রওয়ানা দেব পাঁড়েজীর দোকানের উদ্দেশ্যে। এবার অবশ্য আর আমরা আর চাদর নেব না। ঝকঝকে রোদ উঠেছে যে... রোদ মাখতে মাখতে হাঁটা যাক। 

তারপর সারাদিন অল্প ঘোরাঘুরি খানিক আড্ডা, ঘুরতে ঘুরতে চলে যাওয়া ধু ধু মাঠে পড়ে থাকা বিশাল রাজবাড়ির ধ্বংসাবশেষের কাছে... তারপর আবার গঞ্জের দিকে ফিরে এসে ফের আমরা ঘুরঘুর করব বিশাল বিশাল গেট ওয়ালা এক কালে জাঁকিয়ে বসা, অধুনা পলেস্তরাখসা ইটের মধ্যে থেকে গাছ গজানো পরিত্যক্ত বাড়িগুলোর চারপাশে... কারো কোনো গেটের থামে মুখোমুখি বসে আছে এক জোড়া বিগতশ্রী সিমেন্টের সিংহ...  যাই হোক... দুপুরে আবার একচোট ভাত ডাল দেশীমুরগীর ঝোল দিয়ে পেটপুরে খাওয়াদাওয়া সেরে নেওয়ার পরে নাহয় ভাবতে বসা হবে, আমাদের এত খিদে ছিলো কোথায়!? এবং, এই বিকট পরিমাণ খাদ্যাখাদ্য পেটের কোথায় কোথায় চালান হচ্ছে শেষ অবধি?!!!! 

শীতের বেলা ঝটপট শেষ হয়ে আসার তাড়ায় থাকবে। এখানে এখনো লো ভোল্টেজ থাকে। টিমটিমে বাল্বের আলোয় দিনের শেষে সন্ধ্যাকে বরণ করে নেওয়া হবে... এটাই এখানকার দস্তুর। ঝকঝকে তকতকে কোনো ব্যাপার কোত্থাও নেই, সবই ম্যাড়ম্যাড়ে আর ভয়ানক মায়াবী। মায়াবী সন্ধ্যে নেমে গেলেই দেখতে পাবে এই এলাকায় কী বেশী পরিমাণে থিকথিক করছে ভূত! 

এলাকার সমস্ত গহন অন্ধকার জুড়ে কনসেনট্রেটেড ঘন ভূতের দল মাইল কে মাইল ছড়িয়ে পড়ে থাকা অতীত ঘিরে গিজগিজ করছে। ভূতেদের মধ্যে সাহেব বাঙালি দেহাতি সবাই রয়েছে। দু' চারটে ঘোড়া আর অ্যালসেশিয়ান কুকুরের ভূতও রয়েছে। রাতের রাস্তা জুড়ে ঘোড়া ভূতে সওয়ার সাহেব ভূত তার সঙ্গে প্রিয় পোষ্য অ্যালসেশিয়ান কুকুরের ভূতকে সঙ্গে নিয়ে এ অঞ্চলের ভুতুড়েহাওয়া খেতে বের হয়। এখানকার ভূতের দল ভীষণ নির্লিপ্ত। এরা কাউকে একেবারেই ভয় টয় কিচ্ছু দেখায় না! শুধু লম্বা লম্বা দীর্ঘশ্বাস ফেলে! কিন্তু বেড়াতে আসা কেউ কেউ হয়ত অত পরিমাণ ভূত একসঙ্গে দেখে ফেলে ভয় পেতেই পারে! তার জন্য অবশ্য এখানকার ভূতদের কোনোভাবেই দোষ দেওয়া উচিৎ নয়! 

রাতের টিমটিমে আলোমাখা জমাট অন্ধকারে ভূতেদের দু হাতে ঠেলে সরিয়ে সরিয়ে আমাদের এক পা দু' পা করে এগিয়ে যেতে হবে তাজা সবজীর দোকানে। সেই সবজীর দোকান থেকে আমরা ড্যামচিপ তাজা বেগুন কিনবো, পোকা এবং রাসায়নিক ছাড়া সস্তায় তাজা বড় বড় বেগুন কিনে আমরা আবার দু' হাতে ভূত সরাতে সরাতে হেঁটে হেঁটে পৌঁছে যাবো পাঁড়েজীর দোকানে। পাঁড়েজী ওই তাজা বেগুনগুলোর গায়ে মাপ মতন ছুরি চালিয়ে ছ্যাঁদা করে ঢুকিয়ে দেবে চার পাঁচ কোয়া রসুন আর কাঁচা লঙ্কা। তারপর কয়লার উনোনো বেগুনগুলোকে দেশী টমেটোর সঙ্গে খুব যত্ন করে নিজের হাতে পোড়াতে পোড়াতে পাঁড়েজী আমাদের বলবে, যে এখন তো এখানে আর কিছুই নেই... তবে একসময় এই যায়গাটার একটা 'সময়' ছিলো বটে! পাঁড়েজীর সহকারীরা মুখ বন্ধ করে একের পর এক রুটি বেলে তাওয়ায় সেঁকে উনোনে চিমটে দিয়ে ফুটবলের মতন ফুলিয়ে নরম কাপড়ের ওপর রেখে পাঁজা খানেক রেডি হয়ে গেলে চিল চিৎকার করে কর্কশ গলায় বলবে - ফুলকা তৈয়ার হো গ্যায়া হ্যায়। আমরা অবাক হয়ে নিজনিজ পেটে সেই পাঁজা পাঁজা রুটি অবলীলায় পাকস্থলীর বারমুডা ট্র্যাঙ্গেলে ঠেসেঠুসে ভ্যানিশ করে দিয়ে, দু' হাত দিয়ে ঠেলেঠুলে ভূত সরিয়ে হাঁটতে হাঁটতে আবার ভূতের ডেরার লালকোঠিতে পৌঁছে যাবো। 

হ্যাঁ মশাই শিমূলতলার কথা বলছিলাম...  আগামী সপ্তাহের মাঝখানে দিন চারেকের জন্যে আবার একবার বিহারের শিমূলতলা ঢুঁ মারতে চলেছি একটা ছোটোখাটো ড্রাইভে। যাওয়ার আগে ব্যাগ পত্তর গোছাতে গোছাতে হালকা করে স্মৃতিমেদুর হয়ে পড়েছিলাম তাই ছোট্টো একটা স্মৃতিনির্ভর ভূমিকা ছেড়ে রাখলাম। এরপর ফাঁকে ফোঁকরে অথবা ফিরে এসে দু একটা ছবিছাবা আপলোডিয়ে দেবোখন! আসানসোলের পর থেকে চিত্তরঞ্জন পেরিয়ে 'জামতাড়া-গোড্ডা রোড ধরে' নিলেই রাস্তার দু'পাশ পৌঁছানোর আগেই পয়সা উশুল করে দেবে! আশা করছি প্রতিবারের মতন এবারেও শিমূলতলায় পৌঁছে নেট ফেট পাবো না! আর ইয়ে, একটা ভীষণ জরুরী ইনফো দিয়ে রাখি। যাঁরা শিমূলতলা গিয়ে ইঁদারার মিনারেল মেশানো জলের বদলে প্লাস্টিকের বোতলে কেনা মিনারেল ওয়াটার খেয়ে থাকেন তাঁরা অবশ্যই অ্যান্টাসিড ক্যারি করবেন। নইলে ঐ ডালডা মাখা ঠাণ্ডা শিঙ্গাড়া জিলিপি কিন্তু আপনাদের মাথায় চড়ে চেপে বসবে। ওসব হজম করানো বা পাকস্থলীতে বারমুডা ট্র্যাঙ্গেল বানানো কেনা প্লাস্টিকের জলের বোতলের কম্মো নয়... এইবেলা সবাইকে বলে কয়ে রাখলুম!

পুরনো লেত্তি পুরনো লাট্টু... 
শিমুলতলা, ডিসেম্বর ২০১৭

An idea, like a ghost, must be spoken to a little before it will explain itself... 
...Lord Sinha's place, Shimultala. 

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন