বৃহস্পতিবার, ১৪ সেপ্টেম্বর, ২০২৩

এ কে আর স্যার ~ অরিজিৎ গুহ

আইআইটির প্রথম বর্ষে যে যেই স্ট্রিমেই থাকুক না কেন, প্রত্যেককে সাধারণভাবে কিছু জিনিস পড়তেই হয়। তার মধ্যে একটা হচ্ছে নিউটনের মেকানিক্স। এই বিষয়টা ছাত্রছাত্রীরা সেই ক্লাস নাইন টেন থেকে পড়ে আসছে, আর যারা আইআইটি তে চান্স পেয়েছে সেইসব ছাত্রছাত্রীরা তো এই বিষয়ে নিজেদের একদম অথরিটি ভাবে। উচ্চমাধ্যমিকে হার্ডার প্রবলেম নামের সব অঙ্ক টঙ্ক সলভ করে তারা আইআইটি তে ঢুকেছে। তো তাদেরকে মাস্টারমশাইরা এই মেকানিক্স বিষয়টা পড়াতে গিয়ে বেশ বিব্রতই হন। ছাত্রছাত্রীরা যেন তৈরিই হয়ে থাকে যে কত বড় অধ্যাপক আছে দেখি যে আমাকে নিউটনের মেকানিক্স পড়াবে! কাজেই এই ক্লাসটা করানো মাস্টারমশাইদের কাছে প্রায় দু:স্বপ্নের মত।(অনেকেই হয়ত ভালো পড়ান, আমি গল্পটা শুনেছি এক আইআইটির অধ্যাপকের কাছেই)। তো এরকমই আইআইটির এক অধ্যাপককে ফার্স্ট ইয়ার মেকানিক্স এর ক্লাস নিতে হবে। উনি তো পড়লেন মহা সমস্যায়। ছাত্রছাত্রীদেরকে ক্লাসে ধরে রাখা শুধু নয়, বেয়ারা বেয়ারা উদ্ভট প্রশ্নের ঠিকঠাক জবাব দেওয়া সবই সামলাতে হবে। ভাবতে ভাবতেই তাঁর মাথায় এলো প্রেসিডেন্সিতে পড়ার সময়ে তাঁর নিজের মাস্টারমশাই, যাঁর ক্লাস তিনি মন্ত্রমুগ্ধের মত শুনতেন তাঁর কথা। মেকানিক্স নিয়ে তাঁর একটা বইও রয়েছে। বইটা তিনি পড়েছেন। অধ্যাপক করলেন কি তাঁর মাস্টারমশাই এর লেখা বইটা থেকে লাইন বাই লাইন তুলে ক্লাসে পড়াতে শুরু করলেন। পুরো ক্লাসরুম মন্ত্রমুগ্ধের মত নিউটনের মেকানিক্স এর ওপর লেকচার শুনে গেল। যেন পিনপতনের মত নিস্তব্ধতা ক্লাস রুম জুড়ে। ক্লাস শেষ হওয়ার পর অধ্যাপক মশাই হাঁপ ছেড়ে বাচলেন। আরেকবার তাঁর স্যারের উদ্দেশ্যে মনে মনে প্রণাম ঠুকলেন। 

      যে স্যারের লেখা বই থেকে আইআইটির ওই অধ্যাপক ক্লাসে পড়ালেন সেই স্যারকেই সাহা ইন্সটিটিউটে আমন্ত্রণ করে নিয়ে যাওয়া হয়েছে টক দেওয়ার জন্য। বিখ্যাত পদার্থবিদ, সাহা ইনস্টিটিউটের তৎকালীন ডিরেক্টার ডক্টর বিকাশ সিনহা ছাদে নিয়ে গিয়ে স্যারের সাথে আড্ডা মারতে মারতেই বলে উঠলেন সরকার থেকে একটা বড় গ্রান্ট আসছে আমাদের আগামী এই প্রোজেক্টের জন্য বলে প্রোজেক্টের নামটা বললেন। বিকাশ সিনহা এরপর সেই প্রসঙ্গে স্যারের মতামত জানতে চাইলেন। স্যার তাঁর স্বভাবসুলভ একটু মুচকি হেসে বললেন আমি আমার কাজ করি কাগজের পাতায়। সেখানে ইকুয়েশন লিখি, সলভ করি, এরপর সেগুলো ডাকযোগে পাঠাই বিদেশে। খুব বেশি হলে হয়ত শ খানেক টাকার ব্যাপার। আপনাদের এই কোটি কোটি টাকার প্রোজেক্ট কি আমি বুঝব! স্যারের স্বভাবসুলভ রসিকতা। উল্লেখ্য বাঙালি এই পদার্থবিদের গবেষণা নিয়ে তখন কাজ করছেন বেশ কয়েকজন নোবেল লরিয়েট, এবং ভবিষ্যতেও কয়েকজন পদার্থবিদ নোবেল পাবেন তাঁর কাজের ওপর ভিত্তি করেই। 
 
কী নিয়ে কাজ করেছিলেন বাঙালি এই পদার্থবিদ? একটু দেখে নিই। 
    এই যে মহাবিশ্বে আমরা সহ সমস্ত গ্রহ নক্ষত্র ছায়াপথের অবস্থান, এরা আসলে ডুবে রয়েছে এক বিশাল মহাসমুদ্রের মধ্যে। এই মহাসমুদ্রের নাম স্পেস-টাইম। নিউটন যে গ্রহ নক্ষত্র বা যে কোনো দুটি বস্তুর মধ্যে আকর্ষণ বলের কথা বলেছিলেন, আইনস্টাইন নিউটনের সেই তত্ত্বকে কিছুটা পরিমার্জিত করে সেই আকর্ষণ বলকে বলেছিলেন স্পেস-টাইমের বক্রতা। আসলে দুটি বস্তু একে অপরকে আকর্ষণ করে নিউটনের ভাষ্যমতে। এবং এটাই বস্তুর স্বাভাবিক প্রবৃত্তি। বস্তুর এই প্রবৃত্তি বা আকর্ষণ বলের নাম তিনি দিয়েছিলেন গ্র‍্যাভিটি। আইনস্টাইন বললেন যে না, গ্র‍্যাভিটি কোনো আকর্ষণ বল নয়। যে কোনো বস্তু ডুবে থাকে স্পেস-টাইমের মহাসমুদ্রের মধ্যে এমনভাবে, ঠিক যেমনভাবে রবারের চাদরের মধ্যে কোনো বস্তু ডুবে থাকে। রবারের চাদরটা হচ্ছে স্পেস-টাইম। এবার সেই স্পেস-টাইমের মধ্যে বস্তু ডুবে থাকলেই সেই বস্তু তার চারদিকের রবারের চাদরটাকে যেমন বেকিয়ে চুরিয়ে দেয়, সেরকমই যে কোনো বস্তু তার চারদিকের স্পেস-টাইম বেকিয়ে চুরিয়ে দেয়। এই যে বেকিয়ে চুরিয়ে দেওয়া হল সেই বক্রতার মধ্যে অন্য কোনো বস্তু এসে পড়লে আগের বস্তুর দিকে সে ধেয়ে যাবে যদি আগের বস্তুর থেকে পরের বস্তুটা হাল্কা হয়, অথবা আগের বস্তুটাকে নিজের দিকে টেনে আনবে যদি ভারী হয়। আইনস্টাইন বললেন এটাই গ্র‍্যাভিটি। অর্থাৎ এটা বস্তুর কোনো আকর্ষণ বল নয়। বস্তুর স্পেস-টাইমের বক্রতাটাই হচ্ছে গ্র‍্যাভিটি। 
     বেশ ভালো কথা। মহাজাগতিক যে কোনো স্থানে যদি কোনো বস্তুর উপস্থিতি না থাকে তাহলে সেখানে স্পেস-টাইম থাকবে একদম টানটান হয়ে। অর্থাৎ ফ্ল্যাট স্পেস-টাইম। এই ফ্ল্যাট স্পেস-টাইম এর মধ্যে যদি ধরে নিই যে কোনো দুটি বস্তুকে যারা এই স্পেস-টাইমকে প্রভাবিত করছে না, অর্থাৎ টানটান করে রাখা চাদরের ওপর দুটো চিনির দানাকে যদি ধরে নিই, তাহলে সেই চিনির দানা দুটো নিউটনের তত্ত্ব অনুযায়ী একে অপরকে আকর্ষণ করবে এবং এই আকর্ষণ বলের মান হবে দুজনের ভরের সমানুপাতিক এবং দুরত্বের বর্গের ব্যাস্তানুপাতিক। এমনকি চিনির দানা দুটোকে স্থির অবস্থায় ফেলে রাখলে ওই চাদরেই তারা স্থির অবস্থায় চিরকাল থেকে যাবে এবং বাইরে থেকে যে কোনো একটা চিনির দানাকে কিছুটা এগিয়ে দিলে যদি চাদরের ঘর্ষণ বল ধরে নিই শূন্য তাহলে সেই চিনির দানাটা চিরকাল একই বেগে চলতে থাকবে। নিউটনের প্রথম সূত্র। অর্থাৎ স্পেস-টাইমের প্রভাব না থাকলে নিউটনের সূত্র একদম খাপে খাপ পঞ্চুর বাপ হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু যখনই স্পেস-টাইমকে বিবেচনার মধ্যে আনছি তখন আর নিউটনের সূত্র কাজে দিচ্ছে না। তখন যে সূত্র মানতে হবে সেটা ১৯১৫ সালে আইনস্টাইন বের করেছিলেন তাঁর সাধারণ আপেক্ষিকতাবাদের সূত্রে। 
    আইনস্টাইনের এই আপেক্ষিকতাবাদের সূত্র আবিষ্কারের পরের বছরই সেই সূত্রের একটা সমাধান বের করলেন সোয়ার্জচাইল্ড যেখানে তিনি এক অদ্ভুত সমস্যার উত্থাপন করলেন। কোনো বস্তুকে চাপ দিয়ে ছোট করতে করতে এমন একটা অবস্থা আসে যে অবস্থায় সেই বস্তু তার চারপাশের স্পেস-টাইমকে এমনভাবে গুটিয়ে ফেলে যে তার ভেতর থেকে কোনো কিছুরই আর বেরিয়ে আসা সম্ভব হয় না। এটাকে যদি রবারের চাদর দিয়ে ভাবি তাহলে কীরকম হবে দেখা যাক। রবারের চাদরের মধ্যে ধরা যাক দশ কেজি ওজনের বেশ বড়সর, মানে একটা ফুটবলের আকারের একটা লোহার বল রেখেছি। সেই বলটা তার আসেপাশের চাদরটাকে দুমরে মুচরে দিয়ে স্পেস-টাইমের বক্রতা সৃষ্টি করেছে। এবার লোহার বলটাকে গলিয়ে ছোট করে একটা ক্রিকেট বলের সাইজ করে ফেললাম। অর্থাৎ দশ কেজি ওজনের একটা ক্রিকেট বল। সেই বলটা তখন চাদরটাকে যে দুমরে মুচরে দেবে এবং নিচে টেনে ধরে রেখে দেবে তার গভীরতা আগের বলের থেকে অনেক বেশি হবে। এবার যদি বলটাকে একটা দশ কেজি ওজনের গুলির সাইজে নিয়ে আসি তাহলে তখন গুলিটা চাদরটাকে এমনভাবে নিচের দিকে টেনে ধরে রাখবে যে ওপর থেকে সেটাকে অনেক গভীর বলে মনে হবে। এবার একটা পিঁপড়েকে ওই চাদরের মধ্যে ফেলে দিলাম। তখন কী দেখা যাবে? দেখা যাবে বলটা যখন ফুটবলের আকারে ছিল, পিঁপড়েটা তখন রবারের চাদরে বলের প্রভাব এড়িয়ে দোমড়ানো মোচড়ানো জায়গা পেরিয়ে টানটান জায়গায় উঠে আসতে পারছে। ক্রিকেট বলের সাইজে যে রবারের চাদরের দোমড়ানো মোচড়ানো অবস্থা, হাঁচড়পাঁচড় করে হলেও উঠে আসতে পারছে, কিন্তু গুলির সাইজের বলটা চাদরের যে অবস্থা করছে, সেখান থেকে পিঁপড়েটা আর টানটান জায়গায় উঠে আসতে পারছে না। এরকমভাবে গুলির সাইজ আরো ছোট করতে করতে বিন্দুসম করে ফেললে তার আসেপাশের রবারের চাদরের বক্রতাকে সেই গুলিটা করে ফেলবে অসীম। 
     ওই গুলির সাইজের বলটা চাদরের যে অবস্থা তৈরি করল সেটাকে নাম দেওয়া হল ট্র‍্যাপড সারফেস। দেখা গেল এই ট্র‍্যাপড সারফেসের মধ্যে আইনস্টাইনের সাধারণ আপেক্ষিকতাবাদের সূত্র ঠিকঠাক মিলছে না। কোনো বস্তু, আমাদের আলোচ্য ক্ষেত্রে ওই পিঁপড়েকে যদি ধরি, তাহলে পিঁপড়েটা ওই ট্র‍্যাপড সারফেসের মধ্যে পড়লে অবধারিতভাবে সে গুলিটা চাদরটাকে টেনে ধরে যে একদম নিচের দিকে নামিয়ে এনেছে, সেই নিচের দিকে এগিয়ে চলবে। এর প্রভাব থেকে রেহাই পাওয়ার কোনো উপায় নেই। যেহেতু ওই ট্র‍্যাপড সারফেসের মধ্যে স্পেস-টাইমের বক্রতা হয়ে যাচ্ছে অসীম বা আনডিফাইনড, কাজেই সেক্ষেত্রে আইনস্টাইনের সমীকরণ এই ট্র‍্যাপড সারফেসের মধ্যে কাজ করছে না। বোঝাই যাচ্ছে যে এই ট্র‍্যাপড সারফেস বলে যেটা বলছি সেটা একটা ব্ল্যাক হোলকে বোঝাচ্ছে। ব্ল্যাক হোলের মত অভ্যন্তরের জ্যামিতি বা অভ্যন্তরে বস্তুর পরিণতি এটা যখন আইনস্টাইনের সমীকরণ দিয়ে বের করা সম্ভব হল না তখন প্রয়োজন হল আরো সাধারণ একটা সমীকরণের। 
            ১৯৫৩ সালের ১৪ই সেপ্টেম্বরে প্রথমবার কলকাতায় প্রকাশিত একটা পেপার যা পরে ফিজিকাল রিভিউ নামের বিজ্ঞান পত্রিকায় ১৯৫৫ সালের মে মাসে প্রকাশিত হয়; সেই পেপার এই ট্র‍্যাপড সারফেসের অভ্যন্তরে স্পেসটাইমের বক্রতা সংক্রান্ত সমস্যা থেকে বিজ্ঞানীদের মুক্তি দিল। পরবর্তীকালে এই পেপারে যে সূত্র প্রকাশিত হয়েছিল সেই সূত্রকে কাজে লাগিয়ে বিজ্ঞানী রজার পেনরোজ প্রমাণ করলেন কৃষ্ণগহ্বর থাকলে অবধারিতভাবে তার একটা ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র বিন্দুসম স্থান থাকবে যার নাম সিঙ্গুলারিটি বা সিঙ্গুলার পয়েন্ট; যেখানে স্পেস-টাইম কার্ভেচার হবে অসীম।      পেনরোজের এই ধারণা এবং তিরিশের দশকে এডউইন হাবল এর পর্যবেক্ষণের ফলে প্রাপ্ত মহাবিশ্বের প্রসারণের ধারণা, এই দুই ধারণাকে কাজে লাগিয়ে স্টিফেন হকিং কিছু গাণিতিক হিসাব নিকাশের মাধ্যমে মহাবিশ্বের একটা সম্ভাব্য শুরুর সময় বের করে ফেললেন। উল্লেখযোগ্যভাবে দেখা গেল মহাবিশ্বের শুরুর সেই সময়তেও অবধারিতভাবে একটা সিঙ্গুলারিটি ছিল যে সিঙ্গুলারিটিতেও স্পেসটাইমের বক্রতা ছিল অসীম।
    যে কোনো বড় নক্ষত্রের ভবিষ্যৎ পরিণতি হচ্ছে ব্ল্যাক হোল আর মহাবিশ্বের অতীত শুরু হচ্ছে বিগ ব্যাঙ্গ থেকে এবং এই দুই ক্ষেত্রেই, অর্থাৎ একটা ভবিষ্যতের পরিণতি এবং আরেকটা অতীতের শুরুর সময়ে, দুই ক্ষেত্রেই অবধারিতভাবেই একটা সিঙ্গুলারিটি থাকবে। এই তত্ত্বকে হকিং আর পেনরোজ দুজনের নামে বলা হয় হকিং-পেনরোজ সিঙ্গুলারিটি থিওরেম। 
           হকিং আর আর পেনরোজ এই দুই পৃথিবী বিখ্যাত বিজ্ঞানী তাঁদের সিঙ্গুলারিটির তত্ত্ব আবিষ্কারই করতে পারতেন না ১৯৫৩ সালের ১৪ই সেপ্টেম্বর কলকাতায় প্রথমবার প্রকাশিত ওই পেপারের একটি গাণিতিক সূত্র ছাড়া। গর্বের বিষয় সেই গাণিতিক সূত্রটি প্রণীত হয়েছিল এক কৃতি বঙ্গসন্তান দ্বারা।
    
             মহেন্দ্রলাল সরকার দ্বারা প্রতিষ্ঠিত ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন ফর দ্যা কাল্টিভেশন অফ সাইন্স এর অধিকর্তা তখন মেঘনাদ সাহা। প্রতিষ্ঠান কাজ করে মূলত পরীক্ষামূলক পদার্থবিজ্ঞানের এর ওপর। নানা যন্ত্রপাতির ক্রমাঙ্কন, পরীক্ষাগারে নানারকম পরীক্ষা নিরীক্ষা এ সবই হচ্ছে তখন প্রতিষ্ঠানের কাজ। এরকম সময়ে কলকাতার সাইন্স কলেজ থেকে অমল নামের একটি ছেলে যুক্ত হল ইনস্টিটিউশনে। ছেলেটির উৎসাহ তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানে। মহাবিশ্বের রহস্য তাকে অপার বিস্ময় প্রদান করে। সে যখন মাস্টার্স ডিগ্রি করছে তখন আইনস্টাইনের সাধারণ আপেক্ষিকতার ওপর কাজ করছেন ফাউলার চন্দ্রশেখর ওপেনহাইমার যাদের নাম আগেই উল্লেখ করা হয়েছে। হোয়াইট ডোয়ার্ফ, নক্ষত্রের পরিণতি, ম্যাজিক স্ফিয়ার বা ডার্ক স্টার (ব্ল্যাক হোল নাম তখনো আসে নি, খুব আদি পর্যায়ে কৃষ্ণগহ্বরের একটা ধারণা যা সোয়ার্জচাইল্ডের তত্ত্ব থেকে এসেছিল, সেরকম একটা ধারণা পোষণ করা হত। হুইলার কৃষ্ণগহ্বর নামকরণের আগে এরকম বস্তুকে এইসব নামেই ডাকা হত) এইসবই তখন তাকে বুঁদ করে রেখেছিল। অথচ কাল্টিভেশনে এসে তাকে ব্যাস্ত থাকতে হচ্ছে পরীক্ষামূলক পদার্থবিজ্ঞানে যা তার একেবারেই না পসন্দ। কাজের জায়গা পছন্দ হচ্ছে না। অথচ ইন্সটিটউশন ছেড়েও সে কিন্তু যেতে পারছে না। তাকে আটকে রাখছে ইনস্টিটিউশনের লাইব্রেরির সম্ভার। প্রচুর প্রচুর বই এর সন্ধান সে পাচ্ছে লাইব্রেরি থেকে যার মধ্যে তার পছন্দের বিষয়ের বইও রয়েছে। ১৯৪৫ থেকে ১৯৪৯ অব্দি সে থেকে গেল ইনস্টিটিউটে।      ১৯৪৯ এ আশুতোষ কলেজে একটা অস্থায়ী লেকচারের পদে যোগ দিল। এই সময়ে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞানের অধ্যাপক নিখিল রঞ্জন সেনের সংস্পর্শে আসে। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে তখন জেনারাল রিলেটিভিটি নিয়ে একমাত্র নিখিল রঞ্জন সেনদের গ্রুপ কাজ করছিলেন। কলেজে পড়ানোর ফাঁকে ফাঁকে সে এই অধ্যাপকের সেমিনারগুলোয় উপস্থিত থাকতে শুরু করল।
     ১৯৫১ সালে আবার সে কাল্টিভেশনে ফিরে এলো। এবার স্থায়ী রিসার্চ ফ্যাকাল্টি হিসেবে। ১৯৫৩ সালে কাল্টিভেশনে থাকতে থাকতেই সে তার প্রথম গবেষণা পত্রটি লিখল যা সাধারণ অপেক্ষবাদের অনেকদিনের সমস্যার সমাধানের দ্বার খুলে দেয়। ১৯৫৩ সালের ১৪ই সেপ্টেম্বর কাল্টিভেশন অফ সাইন্সে গবেষণারত ছেলেটির তিরিশ বছরের জন্মদিনের দিন কাল্টিভেশন অফ সাইন্সেই একদল বরিষ্ট বিজ্ঞানীদের সামনে সে তার পেপারটি পেশ করল। ছেলেটির এই দিনটির কথা খুব ভালোভাবে মনে ছিল যেহেতু সেটা তার জীবনের বিশিষ্ট্য একটা দিন এবং ঘটনাক্রমে সেটা তার জন্মদিনেরই দিন। ইকুয়েশনটা শুধুমাত্র যে স্পেস-টাইমের যে কোনো অবস্থার একটা সাধারণ ইকুয়েশন শুধু তাই নয়, যেখানে যেখানে বস্তু আছে এবং যেখানে শক্তি, ভরবেগ,,চাপ আর shear stress(এর বাংলা পাওয়া গেল না। বিষয়টা অনেকটা একটা বাক্সের দুটো পাশ দু হাত দিয়ে ধরে এক হাত দিয়ে বাক্সটাকে ওপর দিকে চাপলে আরেক হাত দিয়ে বাক্সটাকে নিচের দিকে চাপলে বাক্সটা যেরকম চাপ অনুভব করবে সেরকম চাপ) থাকবে, সেই জায়গাতেই এই ইকুয়েশন কাজ করবে। যেমন সুনামির ক্ষেত্রে যে shear stress থাকে তার কস্টিক পয়েন্ট অর্থাৎ যেখানে সুনামির প্রাবল্য সর্বাধিক, সেই কস্টিং পয়েন্ট বের করা সেটাও এই ইকুয়েশন দিয়ে সম্ভব। 
     কাল্টিভেশনের ওই সিনিয়ার বিজ্ঞানীদের পক্ষে তখনই আন্দাজ করা সম্ভব ছিল না অমল নামের ওই ছেলেটির সূত্রটা কতটা শক্তিশালী! সে যে মহাবিশ্বের একটি গুরুত্বপূর্ণ রহস্যের সমাধান করে ফেলেছে সেটা কাল্টিভেশনের এক ঘন্টার সেই সেমিনারে উপস্থিত থাকা বিজ্ঞানীদের জানা ছিল না। পরিবর্তে তাকে ইনস্টিটিউট থেকে প্রফেসার প্রিয়দারঞ্জন রায়ের সাথে দেখা করতে বলা হয় এবং প্রিয়দারঞ্জন রায় তাকে বলেন 'অমল, ওইসব রিলেটিভিটি ফিটি ভুলে যাও, তুমি কোয়ান্টাম কেমিস্ট্রি নিয়ে কাজ করো'। প্রফেসার তাকে অনেক বই পত্তরও দেন পড়াশোনা করার জন্য। এমনকি ১৯৫৫'র মাসে যখন ফিজিকাল রিভিউতে প্রকাশিত হয় এই পেপারটি, তখনও আন্তর্জাতিক বিজ্ঞানীমহলে খুব একটা সাড়া জাগায় নি। অবশেষে ১৯৫৫ সালে হামবুর্গে পাস্কাল জর্ডান সেমিনারে সৌভাগ্যবশত পদার্থবিদ রতনলাল ব্রহ্মচারী উপস্থিত ছিলেন। যিনি পরে ব্যাঘ্র বিশেষজ্ঞ হন। রতনলাল ব্রহ্মচারী লক্ষ্য করেন জ্যোতির্পদার্থবিদ অটো হেকমান আর এঙ্গেলবার্ড শুকিঙ্গ 'রায়চৌধুরি ইকুয়েশন' বলে একটা পেপার নিয়ে বেশ আগ্রহের সাথে আলোচনা করছেন। রতনলাল ব্রহ্মচারীর মাধ্যমে অমল কুমার রায়চৌধুরীর কাছে খবর এসে পৌঁছায় যে বিদেশে তার 'ইকুয়েশন' এর খুব আলোচনা চলছে। এর দশ বছর পরে যখন হকিং পেনরোজ সিঙ্গুলারিটি থিওরেম প্রকাশিত হল এই রায়চৌধুরী ইকুয়েশনকে চাবিকাঠি করে ততদিনে অমল কুমার রায়চৌধুরী প্রেসিডেন্সিতে অধ্যাপক হিসেবে সুপ্রতিষ্ঠিত। ২০২০ সালে রজার পেনরোজ ব্ল্যাক হোল গবেষণার জন্য যখন নোবেল প্রাইজ পেলেন, ততদিনে প্রয়াত হয়েছেন একেআর।
            প্রেসিডেন্সির অধ্যাপক অমল কুমার রায়চৌধুরীকে আম বাঙালি স্টিফেন হকিং বা রজার পেনরোজের মত অত ভালোভাবে না চিনলেও প্রেসিডেন্সির যারা পদার্থবিজ্ঞানের ছাত্রছাত্রী, বিশেষত ১৯৬১ থেকে ১৯৮৮ অব্দি, তাঁরা প্রত্যেকেই একেআর নামের সাথে সুপরিচিত। তিনি যে একজন বিখ্যাত গবেষক বা উজ্জ্বল পদার্থবিদ ছিলেন শুধু তাই নয়, শিক্ষক হিসেবেও দৃষ্টান্ত স্থাপন করে গেছেন। তাঁর 'রায়চৌধুরী ইকুয়েশন' যদি নাও থাকত, শিক্ষক হিসেবেই তিনি একজন জ্যোতিষ্ক হিসেবে বিরাজমান থাকতেন। তাঁর শিক্ষক জীবনের অসংখ্য গল্পের মধ্যে দুটি খুব বিখ্যাত গল্প তাঁরই ছাত্রদের মুখে শোনা যেখানে বোঝা যায় বিখ্যাত 'একেআর স্যার' হিসেবে তিনি তাঁর ছাত্রদের কীভাবে আগলে রাখতেন। এছাড়াও তাঁর স্বভাবগত রসিকতাও গল্পদুটির মধ্যে দিয়ে ফুটে ওঠে।  
             সাতের দশক। ঘোর নকশাল আমল। প্রেসিডেন্সিতে ক্লাস করাচ্ছেন একেআর। ঠিক সেইসময়ে কয়েকটা ছেলে হইহই করে এসে ক্লাসরুমের বাইরে দাঁড়াল। লক্ষ্য ক্লাসরুমের মধ্যের তাদের বিরোধী ছাত্র ইউনিয়নের একটা ছাত্র। ক্লাস শেষ হলেই তাকে তারা ধরবে এবং উত্তম মধ্যম দেবে। একেআর বুঝে যান সেটা। ক্লাস শেষ হওয়ার পর তিনি বাইরের সেই ছাত্রদের মুখোমুখি দাঁড়ান। জিজ্ঞাসা করেন তোমরা এখানে কেন? ছাত্রদের মধ্যে যে একটু নেতা গোছের, সে বলে স্যার আমরা অমুকের সাথে একটু দেখা করব। ইতিমধ্যে সেই অমুক ছাত্রটি ক্লাসরুমের ভেতর দিয়ে টিচার্স রুমে ঢুকে সেখান দিয়ে বেরিয়ে গেছে। প্রেসিডেন্সির ফিজিক্স ডিপার্টমেন্টের ভূগোলটা যারা জানেন তারা এই ব্যাপারটা বুঝতে পারবেন। ক্লাস রুমের ভেতর দিয়েই টিচার্স রুমে আসা যাওয়া করা যেত। 
     নেতা গোছের ছাত্রটির কথা শুনে একেআর বললেন 'কিন্তু আমি যতদূর জানি সে তো তোমাদের সাথে দেখা করতে চায় না'।
    'না স্যার, ওর সাথে আমাদের দেখা করতেই হবে' ছাত্ররাও নাছোরবান্দা। 
   স্যার বললেন 'তোমাদের কথা শুনে বোঝা যাচ্ছে তোমরা ছেলেটিকে পছন্দ করো না। আর ছেলেটিও আমি জানি তোমাদের পছন্দ করে না। তো তোমারা কেউই যখন কাউকে পছন্দ করো না তখন সব থেকে ভালো সমাধান হচ্ছে তোমরা কেউই কারো সাথে দেখা করো না'।
    ছাত্র নেতার ছাত্রদের বক্তব্য 'স্যার আপনি বুঝতে পারছেন না, ও আমাদের ইউনিয়নে ছিল, ভুল করে অন্য ইউনিয়নে চলে গেছে। ছেলে যখন ভুল করে তখন অভিভাবক হিসেবে বাবাই তো তাকে বোঝাবে! আমরা ওকে বোঝাতে এসেছি'। 
    স্যার বললেন, 'ও তুমি ওর বাবা! আচ্ছা। আমি আসলে বুঝতে পারি নি তোমাকে দেখে'। 
   ছাত্ররা এরপর আর স্যারের সামনে কোনো প্রতিযুক্তি খাঁড়া করতে না পেরে রণে ভঙ্গ দেয়।
   ওই সাতের দশকেরই ঘটনা। প্রধানমন্ত্রী ঘোষণা করেছেন কুড়ি দফা কর্মসূচী। তাঁর দলের ছাত্র ইউনিয়ন থেকে ছাত্রদের জন্য একটা প্রশ্নপত্র তৈরি করা হয়েছে। সেই প্রশ্নের মধ্যে একখানা প্রশ্ন রয়েছে প্রধানমন্ত্রীর কুড়ি দফা কর্মসূচী সম্পর্কে তোমার কী মত। সেই প্রশ্নের উত্তরে একজন ছাত্র লিখেছে 'পুরো ধাপ্পা'। ছাত্র ইউনিয়ন তো সেই উত্তর দেখে রেগেই অগ্নিশর্মা! কোনোরকমভাবে একেআর উক্ত ছাত্র আর ছাত্র ইউনিয়নের মধ্যে জড়িয়ে পড়েন। ছাত্র ইউনিয়নের নেতারা স্যারকে বলে, 'স্যার দেখুন, প্রধানমন্ত্রীর কর্মসূচীকে কীভাবে লিখেছে! আপনি বলুন স্যার এভাবে লেখা কি ঠিক হয়েছে?' 
   স্যারের জবাব 'ছোটর মধ্যে গুছিয়ে ভালোই তো লিখেছে!' স্যারের কথার ওপরে আর কথা চলে না। সে যাত্রায় উক্ত ছাত্রটি ছাত্র ইউনিয়নের হাত থেকে স্যারের জন্য বেঁচে গেল।

     এই ছিলেন একেআর। খুব কম শিক্ষকই হয়ত এভাবে ছাত্রদের আগলে রাখে। দেশে বিদেশে ছড়িয়ে থাকা একেআর স্যারের প্রচুর প্রতিষ্ঠিত ছাত্র এখনো একেআর বলতে অজ্ঞান। বাঙালির অনেক আক্ষেপের মধ্যেই আরো বড় এক আক্ষেপ যোগ হতে পারে হাতেগোণা কয়েকটা ইনস্টিটউশন ছাড়া বিখ্যাত এই অধ্যাপকের জন্মশতবর্ষ সম্পর্কে আর কেউ অভিহিতই হল না। আজ থেকে ঠিক একশ বছর আগে ১৯২৩ সালের ১৪ই সেপ্টেম্বর যে মহীরুহের জন্ম হয়েছিল, তাঁর জন্ম বাঙালির অনায়াসেই গর্বে বুক ফুলে ওঠার কথা।

(পরের গল্প দুটি কাল্টিভেশন অফ সাইন্সে একেআর এর জন্মশতবর্ষ উদযাপনের অনুষ্ঠানে প্রফেসার পলাশ বরণ পালের মুখে শোনা। দ্বিতীয় ছবিতে কাল্টিভেশনেরই ওই অনুষ্ঠানে প্রেসিডেন্সির বর্তমান ফিজিক্স এর হেড অফ দ্যা ডিপার্টমেন্ট প্রফেসার অরুনাভ চক্রবর্তীর প্রাক্তন হেড অফ দ্যা ডিপার্টমেন্ট প্রফেসার একেআরের প্রতি শ্রদ্ধাজ্ঞাপন।)

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন