ভারত একটা গণতান্ত্রিক দেশ। টিকা নেয়া না নেয়া নিজস্ব ব্যক্তিগত সিদ্ধান্ত। আমি স্বাস্থ্য কর্মী হিসেবে নিজে নিয়েছি এবং অন্যদের নেয়ার অনুরোধ জানাচ্ছি, গুজবে কান না দিয়ে আপনারাও নিন। সেই অনুরোধ জানানোর সাথে কেন জানাচ্ছি তা ব্যাখ্যা করার দায় থেকে যায়।
প্রথমে আসা যাক ভ্যাকসিন ঘটিত পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া নিয়ে যার চরম রূপ হল মৃত্যু। গুজব রটানো হয়েছে যে ভ্যাকসিন নিয়ে মৃত্যু ঘটেছে। এ ক্ষেত্রে যা বলার তা হল, টেম্পোরালিটি অর্থাৎ ঘটনাক্রম দিয়ে কজাল অর্থাৎ কার্যকারণ সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করা এক ধরণের ফ্যালাসি বা কুযুক্তি। কাক ডাকলো আর তার পরে তাল গাছ থেকে তাল খসে পড়লো এ দুটোর মধ্যে কোনও কার্যকারণ সম্পর্ক নেই। ভ্যাকসিন নিল আর তার পরে মরে গেল মানেই ভ্যাকসিন এর জন্য মরে গেল তা নয়। অন্য কারণ থাকতে পারে। যার মৃত্যুর উদাহরণ দেওয়া হচ্ছে, তিনি ভ্যাকসিন এর কারণে মারা গেছেন সেটি বৈজ্ঞানিক ভাবে প্রমাণিত হয়েছে কিনা দেখতে হবে।
দ্বিতীয় যে গুজব রটানো হচ্ছে তা হল এই যে ব্যবসায়িক বা রাজনৈতিক স্বার্থ পূরণের জন্য ভ্যাকসিন তৈরির যে প্রথাগত পর্যায় বা সময়কাল লাগে তা ক্ষুন্ন করে অস্বাভাবিক দ্রুততায় এই ভ্যাকসিন তৈরি, অনুমোদন ও বাজার এ আনা হয়েছে। এর আগে ভ্যাকসিন তৈরির দ্রুততার রেকর্ড ছিল চার বছর, মাম্পস ভ্যাকসিনের ক্ষেত্রে। ডঃ মরিস হিলম্যান নিজের মেয়ের নামে জেরিল লিন স্ট্রেন তৈরি করেন ষাট এর দশকে। কোভিভ এর ক্ষেত্রে রেকর্ড ভাঙা হল একবছর এর কম সময়ে।
এটা মনে রাখা দরকার যে সময়ের ওই রেকর্ড ভাঙার পেছনে ব্যবসায়ীক রাজনৈতিক তাগিদ ছাড়াও অন্য কারণ আছে। সারা পৃথিবীতে পঞ্চাশটির বেশি পরীক্ষাগারে একই সাথে একটি রোগের ভ্যাকসিন তৈরির চেষ্টা এর আগে কোনো দিন হয় নি। ষাট এর দশকের পরে মেডিক্যাল সায়েন্স, ন্যানো টেকনোলজি, মলিকুলার বায়োলজি, কেমিস্ট্রি, ফিজিক্স এত এগিয়ে গেছে তা অকল্পনীয়।
এই এক বছরের রেকর্ড সময়ে আবিষ্কার সম্ভব এর পেছনে বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখার গবেষকদের বহু বছরের সাধনা আছে। যেমন অক্সফোর্ড - এস্ট্রাজেনেকা ভ্যাকসিন যে "ভাইরাল ভেক্টর টেকনোলজি" ChAdOx1 কাজে লাগিয়ে তৈরি হয়েছে সেটা গত দশ বছরের গবেষণার ফল। ওই প্রযুক্তি ব্যবহার এই নতুন ভাইরাসের ভ্যাকসিন তৈরির কাজে লেগেছে। ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল এর আরেকটি প্রতিবন্ধকতা অর্থাৎ স্বেচ্ছাসেবক জোগাড় করাও এই ভ্যাকসিন এর ক্ষেত্রে কোনও সমস্যা হয়েই দাঁড়ায় নি।
তৃতীয় যে গুজব ছড়ানো হচ্ছে তা হল কার্যকারিতা নিয়ে। ভাববাদী শাস্ত্রগুলি থেকে যুক্তিবাদী বস্তুবাদী বিজ্ঞান এখানেই আলাদা যে বিজ্ঞান কোনো দিন দাবি করে না যে শেষ কথা বলে ফেলেছে, আর কিছু বলার নেই। ভ্যাকসিন এর দ্বিতীয় ডোজ এর এক মাস পরের ডাটা সংগ্রহ করা গেছে। এবং দেখা গেছে যে তাতে যথেষ্ঠ পরিমান প্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরি হয়েছে টিকা গ্রহণকারীদের শরীরে। বিভিন্ন মানব গোষ্ঠী অনুযায়ী এটা বিভিন্ন রকম হলেও কমবেশী ৭০% এফেক্টিভ (কোভিশিল্ড)। (একটি ভ্যাকসিন এর ক্ষেত্রে ৯০% এর বেশি)। মনে রাখতে হবে যে এযাবৎ কাল ১০০% কার্যকর এমন কোনো টিকা মনুষ্যজাতি আবিষ্কার করতে পারে নি।
ছয়মাস বাদে সক্ষমতা কতটা থাকবে এ প্রশ্ন যারা তুলছেন তাদের সবিনয়ে জানানো দরকার যে ছয়মাসের ডাটা এখনো হাতে আসে নি। আর আসে নি বলে সুনির্দিষ্টভাবে উত্তর দেয়া সম্ভব নয়।
ভ্যাকসিন নিরাপদ ও কার্যকর কিনা সে নিয়ে ব্যক্তিগত মতামত দেয়ার ও বিতর্কে অংশ নেওয়ার অধিকার কেবল ডাক্তার নয় যে কোনো সাধারণ মানুষের আছে। কেবল অনুরোধ জানাবো যে সপক্ষে যুক্তি সাজানোর সময় জনপ্রিয় মিডিয়ার লিঙ্ক শেয়ার না করে প্রচলিত বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি অনুসরণ করুন। এভিডেন্স বেসড মেডিসিন এর সূত্রঃ ধরে পিয়ার রিভিউ জার্নালে প্রকাশিত বৈজ্ঞানিক প্রবন্ধকে মান্যতা দিন।
এই বাজার অর্থনীতির যুগে সবই বিক্রি হয়, বিজ্ঞানী গবেষকদের সততাও সন্দেহের ঊর্ধে নয়, তবে ল্যানসেট পয়সা খেয়ে প্রবন্ধ প্রকাশ করে বলে অতি বড় বামপন্থীরাও অভিযোগ করেন নি। সেই ল্যানসেট এর একটি ঝলক ভারতের কোভিশিল্ড এর আদি সংস্করণ নিয়ে। উৎসাহীরা পুরো প্রবন্ধটি দেখতে গুগলামো করুন।
এই লেখাটি হয়তো "আপিল টু অথরিটি" ফ্যালাসি দোষে দুষ্ট। কিন্তু ল্যানসেট এর নাম নেয়া ছাড়া উপায় ছিল না।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন