তৃণমূল কে হারাতে, বিজেপির প্রতীকে তৃণমূল কেই ভোট দিন।
যেমন ধরুন, তৃণমূলের তোলাবাজ শুভেন্দু কে হারাতে, বিজেপির তোলাবাজ শুভেন্দু কে ভোট দিন। কিম্বা তৃণমূলের ঘুষখোর মুকুল কে হারাতে, বিজেপির ঘুষখোর মুকুল কে ভোট দিন। আসুন, বাংলার চিটিংবাজ মিডিয়া কে তৃণমূল-বিজেপির বাইনারি ন্যারেটিভে আপনার মাথা খাওয়ার সুযোগ করে দিন। কিন্তু, খবরদার সিপিএম'র কথা বিশ্বাস করবেন না।
ঐ যে আপনি শুনেছিলেন, সিপিএম বলেছিল 'কৃষি আমাদের ভিত্তি, শিল্প আমাদের ভবিষ্যৎ' –আসলে আপনি ওটা ষোল আনাই ভুল শুনেছিলেন। মকর-সংক্রান্তির বাজারে ড্রইংরুমের সোফা তে গা এলিয়ে চুপটি করে এবিপি আনন্দ চালিয়ে বসুন। দেখবেন কিছুক্ষণ পর আপনার মনে হবে নন্দীগ্রামের কেমিক্যাল হাবটা আসলে বানাতে চেয়েছিল শুভেন্দু অধিকারী। চেয়েছিল অখিল গিরি। চেয়েছিল তৃণমূল। চায়নি শুধু বামফ্রন্ট! চায়নি শুধু সিপিএম! চায়নি শুধু বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য!
রিমোট টিপে চ্যানেল বদলে চোখ রাখুন জি-২৪ ঘণ্টার পর্দায়, মনে হবে সিঙ্গুরে আসলে কারখানা করতে চেয়েছিল মুকুল রায়। চেয়েছিল বেচারাম। চেয়েছিল বিজেপি। কদিন পর হয়ত শুনবেন চেয়েছিল মমতাও। চায়নি শুধু বামফ্রন্ট! চায়নি শুধু সিপিএম! চায়নি শুধু বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য!
ঐ যে আপনি দেখেছিলেন, ২০০৬-র ৩রা ডিসেম্বর, সিঙ্গুর ইস্যুতে মমতার ধর্মতলার অনশন মঞ্চের বয়স যখন জাস্ট ৬ঘণ্টা, তখন অনশন মঞ্চে হাজির হয়েছিলেন বিজেপি শীর্ষ নেতা রাজনাথ সিং; আসলে উনি রাজনাথ সিং ছিলেন না, ছিলেন আলাদীনের প্রদীপের জিন। একটা থেকে আড়াইটা; ছিলেন টানা দেড় ঘণ্টা। সাথে সমর্থকরা, বিজেপির দলীয় পতাকা নিয়ে।
সদ্য সংবিধান হাতে বিধানসভার ভাঙচুর করে গণতন্ত্রের শ্রাদ্ধ করা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সেদিন যখন অনশন মঞ্চ থেকে বলছেন "মুখ্যমন্ত্রী ডাকলেও রাজ্য সরকার সাথে সিঙ্গুর নিয়ে কোন আলোচনায় বসব না। যা হওয়ার হোক প্রয়োজনে রক্ত ঝরিয়ে সিঙ্গুর আন্দোলন চলবে" -বিজেপি নেতা রাজনাথ সিং তখন ঠাই দাঁড়িয়ে মমতার পাশে। মাইক হাতে তিনি বলেছিলেন,
- মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় NDA-র গুরুত্বপূর্ণ শরিক। বিজেপি শুধু তাকে সমর্থন করে তাই না, সক্রিয় সমর্থন করে!
সেদিনই সন্ধেবেলা মমতার অনশন মঞ্চে হাজির হয়েছিলেন কার্গিলের নিহত জওয়ানদের কফিন কেলেঙ্কারির 'মিডলম্যান' প্রাক্তন NDA-র প্রতিরক্ষা মন্ত্রী জর্জ ফার্নান্দেজ।
যারা ২০১১-র বামফ্রন্টের নির্বাচনী পরাজয় কে স্বাভাবিক গণতন্ত্রীয় লিনিয়ার ইকুয়েশন মনে করেন, কিম্বা নেত্রী মমতার একক রাজনৈতিক ক্যারিশ্মার জাবর কাটেন, তারা কি বলতে পারেন আজ শুভেন্দু কেন বলছে অটল বিহারী বাজপেয়ী পরামর্শেই এ রাজ্যে নাকি পথ চলা শুরু তৃণমূলের? কেন সেদিন RSS-র প্রত্যক্ষ সমর্থন ছিল মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের তথাকথিত জমি আন্দোলনেও? বলতে পারেন মমতার অনশন মঞ্চের ২০০৬-র রাজনাথ সিং আর আজকের ২০২১-র রাজনাথ সিং কি একই ব্যক্তি না আলাদা? কিম্বা ঠিক কোন কারণে নন্দীগ্রাম ষড়যন্ত্রের 'মাস্টারমাইন্ড' শুভেন্দু বিজেপি ওয়াশিং মেশিনে আজ ধোয়া তুলসী পাতা? সিঙ্গুর আন্দোলনে মমতার ছায়াসঙ্গী মুকুল রায়ের কেন আজ শিল্পের জন্য এই কুমীরের কান্না?
বলতে পারেন পৃথিবীর আর কোন অঙ্গরাজ্যের মহিলা প্রধানের সঙ্গে স্বয়ং এসে দেখা করেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সেক্রেটারি অব স্টেট হিলারি ক্লিনটন? কিম্বা ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরন? কেনই বা ২০০৭-র ফেব্রুয়ারিতে রাজ্যের আপাদমস্তক এক ধর্মীয় নেতা এবং তৎকালীন নন্দীগ্রাম আন্দোলনের বামফ্রন্ট বিরোধী মুখ সিদিক্কুলা চৌধুরীর সাথে রুদ্ধদ্বার মিটিং করেছিলেন মার্কিন কনস্যুলেটের প্রধান? লেনিনিস্ট কনজাংচারে পেয়দাইশ জঙ্গলমহলে কিষানজীর অবশিষ্ট কিছু শহুরে কোয়ার্টার-হাফ-সেম-ফুল ভক্তরা কি বলতে পারেন পুঁজিবাদের এই ম্যাসকটদের ব্লু-আইড কন্যা মমতার 'ক্লাস ক্যারেক্টার'টা ঠিক কি?
উত্তর খুঁজুন। কারণ আপনার হয়ে রাজনৈতিক নেতাদের এই প্রশ্ন গুলো করবে না গণতন্ত্রের 'চতুর্থ স্তম্ভ' মিডিয়া! আসলে আপনার-আমার মত আম পাবলিক কে এই নেতা-মিডিয়ারা 'মানুষ'ই ভাবে না। ভাবে গুরু-ছাগল। ভাবে এরা ঘাসে মুখ দিয়ে চলে। এরাই আপনাকে ২০১১-র আগে গিলিয়েছিলে 'পরিবর্তন চাই'। এরাই আপনাকে ২০২১-র গেলানোর চেষ্টা করছে 'হয় তৃণমূল না হয় বিজেপি!'
বিশ্বাস হচ্ছে না? আচ্ছা আপনি বরং গত এক মাসের বাংলা সংবাদমাধ্যমের যে কোনও টক শো কিম্বা যে কোনও সাংবাদিক সম্মেলনের ভিডিও প্লে-পস-রিওয়াইন্ড করে দেখুন! দেশে ক্রমবর্ধমান অর্থনৈতিক মন্দা, ২৪টি কোয়ার্টারে নিম্নগামী জিডিপি বৃদ্ধির হার, ৪৫ বছরে সর্বোচ্চ বেকারত্ব, হাঙ্গার ইনডেক্সে কিম্বা ডেমোক্রেসি ইনডেক্সে –খেয়াল করে দেখুন তো এসব বিষয়ে কোন সংবাদ মাধ্যম কে কোনদিন দিলীপ ঘোষদের একটাও প্রশ্ন করতে শুনেছেন? শোনেননি তো? আগামী ৩ মাসেও শুনবেন না!
কিম্বা রাজ্যের আম্ফান দুর্নীতি, বেকারত্ব, তৃণমূল নেতা-নেত্রীদের দলবদলের রাজনীতি, সরকারী শূন্যপদ বা সংসদে একের পর এক জনবিরোধী বিলে তৃণমূলের সাংসদদের বিজেপি কে প্যাসিভ সমর্থন– খেয়াল করে দেখুন তো এসব বিষয়ে কোন সংবাদ মাধ্যম কে কোনদিন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কে একটাও প্রশ্ন করতে শুনেছেন? শোনেননি তো? আগামী ৩ মাসেও শুনবেন না!
কেন বলুন তো? উত্তর খুঁজুন! অবশ্যই সিপিএম-র সমালোচনা করুন। কিন্তু অন্ধ সিপিএম বিরোধিতা ছেড়ে যদি যুক্তির বুনিয়াদী বিন্যাসে বিশ্বাস করেন তাহলে উপরের প্রশ্ন গুলোর বস্তুনিষ্ঠ উত্তর খুঁজুন! সিপিএম-র প্রশ্ন গুলোর উত্তর খুঁজুন।
সিপিএম বলেছিলে, রাজ্যের বেকারদের জন্য বৃহৎ শিল্পের প্রয়োজন। সিঙ্গুর-নন্দীগ্রাম-শালবনী, বেকারদের স্বপ্ন পূরণ করতে চেয়েছিলে সিপিএম। ভুল করেছিল? সিপিএম বলেছিল, ২০১১-র নির্বাচনে তৃণমূল কংগ্রেস কালো টাকা ব্যবহার করে ভোট করেছে। সুদীপ্ত সেন, কেডি সিং কিম্বা গৌতম কুণ্ড - সিপিএম ভুল বলেছিল? সিপিএম বলেছিল, নন্দীগ্রামের ষড়যন্ত্রের জন্য আপাদমস্তক দায়ী তৃণমূল। ২০১৪ তে বামফ্রন্ট সরকার কে সিবিআই-র ক্লিনচিট, মমতা সরকারের পক্ষে অভিযুক্ত পুলিশদের পদন্নোতি আর আজকের শুভেন্দু স্বীকারোক্তি -সিপিএম ভুল বলেছিল? সিপিএম বলেছিল, সিঙ্গুরে অনিচ্ছুক কৃষকদের জমি ফেরত দিয়েই না হয় শিল্প হোক। সেদিন রাজি হননি মমতা। আজ সিঙ্গুরে এসে একবার দেখেই যান না হয় –সিপিএম কি ভুল বলেছিল?
সিপিএম বলছে তৃণমূলের জন্যই রাজ্যে বেড়েছে বিজেপি। ভুল বলছে? সিপিএম বলছে একটা নির্বাচন হারলেই তৃণমূল তাসের ঘরের মত ভেঙে পড়বে। ভুল বলছে? সিপিএম বলছে এ রাজ্যের ৯০% বিজেপি নেতা হবেই আসলে প্রাক্তন তৃণমূলী। ভুল বলছে? সিপিএম বলছে বিজেপি হারাতে কেবল বিজেপি নয় হারাতে হবে তৃণমূলকেও? ভুল বলছে? উত্তর খুঁজুন।
হিসেব হবে। রইলাম আমরা। মাটি কামড়ে। শেষতক।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন