শনিবার, ২ জানুয়ারী, ২০২১

দুই ইঞ্জিনিয়ারের গল্প ~ অমিতাভ প্রামাণিক


- স্যার, একটা কথা বলব, যদি কিছু মনে না করেন?
- বলো।
- আচ্ছা, আমরা এই নিউক্লিয়ার পাওয়ার প্রোজেক্টে কাজ করছি কেন? আপনি নিশ্চয় শুনেছেন যে আমেরিকা-জার্মানিতে ওরা নিউক্লিয়ার পাওয়ার প্ল্যান্ট ইনস্টল করে কোটি কোটি টাকা লস খেয়েছে। তা সত্ত্বেও আমরা এই প্রোজেক্টটা নিলাম কেন?
- ইয়াং ম্যান, ইন্ডিয়ার দরকার নিউক্লিয়ার পাওয়ার। নিউক্লিয়ার পাওয়ার পেতে হলে তো এই পাওয়ার প্ল্যান্ট বানাতেই হবে। আমরা যদি সেই কাজটা না করি, তো কে করবে?

কথাটা যিনি বললেন, তাঁর নাম হেনিং, তিনি একজন ড্যানিশ। ডেনমার্ক যে শুধু শ্রীরামপুরেই কলোনি বানিয়েছিল, তা তো নয়। এই হেনিং-এর বন্ধু ভারতের অ্যাটমিক এনার্জি কমিশনের চেয়ারম্যান ডক্টর হোমি জাহাঙ্গির ভাবা। তিনি জানতেন, এ কাজের উপযুক্ত লোক হেনিং, তাই এই পরিকল্পনার ক্রিটিক্যাল কম্পোনেন্ট যেগুলো, তা তৈরির বরাত পেয়েছে তারই সংস্থা।

হেনিং 'ইউনিভার্সিটি অভ কোপেনহেগেন' থেকে কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ, এখন যার নামের আগে 'টেকনিক্যাল' শব্দটা যোগ হয়েছে। পাশ করেই কোপেনহেগেনের এফ এল স্মিথ অ্যান্ড কোম্পানির একটা অ্যাসাইনমেন্ট জুটে যায় তার কপালে। কাজটা হচ্ছে দক্ষিণ ভারতের কোয়েম্বাটোরের কাছে মাদুক্কারাই নামে এক জায়গায় একটা সিমেন্ট ফ্যাক্টরি দাঁড় করাতে হবে। তার জন্যে যন্ত্রপাতি যা লাগবে, সব আসবে বিদেশ থেকে, তাকে এর ইনস্টলেশন-কমিশনিং করতে সহায়তা করতে হবে। সেটা ১৯৩৮ সাল। কাজে যোগ দিয়েই সে অবাক, এখানে এসে কাজ করছে তার ছোটবেলার স্কুলের বন্ধু সোরেন, ঐ একই কোম্পানির হয়ে। সে সিভিল ইঞ্জিনিয়ার, চার বছর আগে সে ইন্ডিয়াতে এসে সিন্ধুপ্রদেশের রোহরিতে অলরেডি একটা সিমেন্ট কারখানা দাঁড় করিয়ে দিয়েছে, এখন তারও কাজ এই মাদুক্কারাই প্রোজেক্টেই।

যথাসময়ে দুই প্রকল্পের কাজ শেষ হয়ে গেল। বোম্বের কাছে মাথেরান হিল স্টেশনে ছুটি কাটাতে গিয়ে দুই বন্ধু এ ওকে বলল – দেশে ফিরে লাভ নেই। চল, এখানেই একটা কোম্পানি খুলে ফেলা যাক। মনে হচ্ছে, ব্যবসা খারাপ হবে না।

বোম্বেতে এক খুদে অফিস খুলে বসে গেল দুই বন্ধু। অফিস মানে একটা পাঁচ বাই পাঁচ মেঝে, তাতে একটা ছোট্ট টেবিল আর একটা চেয়ার। একজন বসলে অন্যজনের সেখানে জায়গা নেই, তাকে বাইরে দাঁড়িয়ে থাকতে হয়। ওরা বুঝে গেল, ইন্ডিয়াতে দুধের ভাল চাহিদা আছে। দুগ্ধজাত বস্তু তৈরির যন্ত্রপাতি বিক্রি হবে ভালো। ডেনমার্কের এক ডেয়ারি যন্ত্রপাতি প্রস্তুতকারকের এজেন্ট হিসাবে কাজ করলে আমদানি মন্দ হবে না।

কিন্তু বেশিদিন সে সব চালানো গেল না। বিদেশ হয়ে উঠল উত্তাল, বেধে গেল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। জার্মানি ডেনমার্কের দখল নিয়ে নিল, ফলে ডেনমার্ক থেকে ইমপোর্ট হয়ে পড়ল অসম্ভব। যন্ত্রপাতি না এলে ব্যবসা কী করে চলবে? বাধ্য হয়ে দুই বন্ধু ঠিক করল, তারা নিজেরাই যন্ত্রপাতি তৈরি শুরু করবে। হেনিং এমনিতেই ঝুঁকি নিতে পছন্দ করে, সে বলল, আমরা সব রকম যন্ত্রপাতি বানাব। সোরেন অপেক্ষাকৃত সাবধানী, কিন্তু তার কাজ নিখুঁত, সে প্রবল পরিশ্রমী ও হার্ড টাস্কমাস্টার। একটা ওয়ার্কশপ মতন খুলে প্রথমে কিছুদিন অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের ছোটখাটো কাজকারবার করতে লাগল, মূলত সার্ভিসিং। পরে নিজেরাই ডেয়ারি ইকুইপমেন্ট তৈরিতে মন দিল।

যুদ্ধ ঘনিয়ে এলে অবশ্য তড়িঘড়ি বুঝে গেল আসল মুনাফা এইসবে নয়, বরং যুদ্ধের সঙ্গে সম্পর্কিত ব্যবসায়। যা তৈরি করবে, নিমেষে সব বিক্রি হয়ে যাবে। সুতরাং আদা নয়, তাদের ব্যবসা হতে হবে জাহাজের। কদিন পরেই হিলডা লিমিটেড নাম দিয়ে তারা জাহাজ সারানোর আর জাহাজের প্রয়োজনীয় পার্টস বানানোর কোম্পানি খুলে ফেলল। তরতরিয়ে চলতে লাগল সেই ব্যবসা।

এদিকে টাটারা তাদের সোডা অ্যাশ কারখানা বানানোর পুরো পরিকল্পনা করে তখন গেছে ফেঁসে। তাদের ইঞ্জিনিয়ার আসার কথা জার্মানি থেকে, এদিকে জার্মানির অক্ষশক্তির সঙ্গেই তো ব্রিটিশ মিত্রশক্তির যুদ্ধ! জার্মানি থেকে ব্রিটিশ ভারতে কাকে আসতে দেবে তখন? ফলে টাটারা লোক খুঁজতে লাগল, যদি উপযুক্ত কাউকে এ কাজের জন্যে পাওয়া যায়।

খবর পেয়ে হেনিং আর সোরেন হাজির হল টাটাদের দপ্তরে। তারা নামিয়ে দেবে ওদের বিশাল সোডা-অ্যাশ কারখানা।

সেই কারখানা সাফল্যের সঙ্গে বানিয়ে তাদের ছক বদলে গেল। ছুটকো-ছাটকা কাজ না, তাদের এখন দরকার বড় বড় এমন প্রোজেক্টের কাজ। ইঞ্জিনিয়ারিং আর কনস্ট্রাকশনের কন্ট্রাক্ট নেবে তারা, ক্লায়েন্ট শুধু বলে দেবে তার কী চাই, তারা পুরো কাজটা নামিয়ে দেবে। বিশ্বযুদ্ধের দমক কমে যেতে বিদেশি কোম্পানিদের সঙ্গেও একসঙ্গে কাজ করতে লাগল তারা। আমেরিকার ক্যাটারপিলার ট্র্যাকটর কোম্পানির সঙ্গে কথাবার্তা হল, তারা বড় বড় কনস্ট্রাকশনের উপযোগী হুঁদো হুঁদো সব আর্থ-মুভিং ইকুইপমেন্ট বিক্রি করবে ইন্ডিয়ায়। দেশে তখন বিস্কুট, কাচ, বনস্পতি, সাবান ইত্যাদির কারখানার যন্ত্রপাতি সরবরাহ করে ব্রিটিশ কোম্পানিরা। এরা তাদেরও এজেন্সি নিয়ে ব্যবসা বাড়িয়ে চলল। এক এক রকম বিজনেসের জন্যে আলাদা আলাদা নামের কোম্পানি চালু করে দিল।

যুদ্ধ শেষ হতে আমেরিকান ক্যাটারপিলার ট্র্যাক্টর কোম্পানির ইন্টারেস্ট কমে গেল। তাদের তৈরি বড় বড় আর্থ-মুভার অবশ্য এদের কনস্ট্রাকশনের জন্যে খুবই কাজের। ওরা বলল, তাহলে তোমাদের এগুলো সস্তায় দিয়ে দিচ্ছি, তোমরা কিনে নাও।

জলের দরে হলেও অতগুলো মেশিন কেনার পয়সা তাদের নেই। দরকার ইনভেস্টমেন্টের, তার জন্যে বাজার থেকে টাকা তুলতে হবে। যার কাছেই টাকা চায়, তারাই ওদের কোম্পানির ব্যবসাপত্রের হিসেব দেখতে চায়। কোম্পানিগুলো ছোট ছোট, তাই ধার পাওয়া মুশকিল। বাধ্য হয়ে সবগুলো একসঙ্গে করে তারা একখানা বড় প্রাইভেট লিমিটেড কোম্পানি বানিয়ে ফেলল, টাকা চলে এল। দেশ স্বাধীন হতে তাদের নতুন অফিস খুলে গেল দিল্লি, কলকাতা, মাদ্রাজেও। পরের বছর বোম্বের এক বড়সড় জলা এলাকা পরিষ্কার করে সেখানে খুলে বসল বিশাল সাইজের ফ্যাক্টরি।

অ্যাটমিক এনার্জি কমিশনের চেয়ারম্যান হোমি ভাবার মতই ইসরোর চেয়ারম্যান বিক্রম সারাভাই-ও এদেরই শরণাপন্ন হলেন, যখন ১৯৭২ সালে ভারতের স্পেস প্রোগ্রাম শুরু হল। পরে এমনকি ভারতের ডিফেন্স রিসার্চের বড় বড় ইঞ্জিনিয়ারিং প্রকল্পের জন্যেও এদের কথাই ভাবা হয়। প্রতিরক্ষার সামগ্রী ভারতের সরকারী ব্যবস্থায় বেসরকারি সংস্থা থেকে নেওয়া যায় না বলে ওদের কাছ থেকে ডিজাইন চাওয়া হয়। সেই ডিজাইন পরখ করে তার বরাত দেওয়া হয় সরকারি কোনো সংস্থাকে।

হেনিং ও তার বাল্যবন্ধু সোরেন ভারতকেই তাঁদের ঘর বানিয়ে নিয়েছিলেন। নিজেদের তৈরি কোম্পানি থেকে অবসর নিয়েও হেনিং দেশে ফিরে যাননি। ২০০৩ সালে ৯৬ বছর বয়সে বোম্বের ব্রিচ ক্যান্ডি হাসপাতালে মারা যাওয়ার আগে তাঁর নামের আগে অনেকগুলো পুরস্কার জ্বলজ্বল করছে। ১৯৭৬ সালে রামন ম্যাগসেসে থেকে শুরু করে তার পরের বছর ড্যানিশ নাইটহুড হয়ে মৃত্যুর আগের বছর তিনি পেয়েছেন ভারতের পদ্মভূষণ, ভারতীয় ডাক তাঁর নামে পোস্টেজ স্ট্যাম্পও ছাপিয়েছে। সোরেন অবশ্য দেশে ফিরে গেছিলেন প্রায় পঞ্চাশ বছর ভারতে কাটিয়ে, ১৯৮১ সালে। কিন্তু সে তাঁর সহ্য হয়নি, পরের বছরই তিনি সেখানে মারা যান। তাঁর স্ত্রী জীবনের শেষ বছরগুলো কাটিয়েছিলেন কোদাইকানালে তাঁদের পারিবারিক বাড়িতেই।

বিভিন্ন ধরনের কারখানা, কমার্শিয়াল ও রেসিডেন্সিয়াল বিল্ডিং, এয়ারপোর্ট, রানওয়ে, হাইওয়ে, রেলওয়ে, মেট্রোরেল, মনোরেল, এলিভেটেড করিডোর, আইটি পার্ক, হাসপাতাল, টানেল, জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র, পরমাণু শক্তিকেন্দ্র – বহুসংখ্যক বড় বড় প্রোজেক্ট সাফল্যের সঙ্গে রূপায়িত করে দেশনির্মাণের এক অন্যতম সহচর এঁদের এই সংস্থা।


দুই উৎসাহী তরুণ ড্যানিশ ইঞ্জিনিয়ার কলেজ থেকে পাশ করেই চলে এসেছিল ভারতে, সেখানেই কেটে গেল তাদের সমস্ত জীবন। হেনিং হল্ক-লার্সেন এবং সোরেন ক্রিস্টিয়ান টুব্রোর 'লার্সেন অ্যান্ড টুব্রো' এখন আমাদের দেশের সবচেয়ে বড় হেভি ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানি এবং কুড়িটা বৃহত্তম মূল্যবান কোম্পানির অন্যতম। 'এল অ্যান্ড টি' এখন পৌনে দু-লক্ষ কোটি টাকার কোম্পানি।
২৩ ডিসেম্বর ২০২০

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন