বেসিক্যালি আপনি হয়ত 'অ্যাপলেটিক্যাল'। মানে গাছেরও খান, তলারও কুড়ান। আদা আর কাঁচকলা দুটোই আপনার সমান পছন্দের। আপনি সাপের মাথাতেও চুমু খান, নেউলের গায়েও হাত বোলান। আপনার বাথরুমের পাশে স্টার-জলসা। আর জীবন মানেই জি-বাংলা।
অক্টোবরে কৃষক ধর্মঘটে স্তব্ধ হয়েছিল রাজস্থান -কিন্তু আপনি তো কৃষক না ¹। ডিসেম্বরে শ্রমিক'দের নূন্যতম মজুরির দাবীতে অবরুদ্ধ হয়েছিল দিল্লির পার্লামেন্টে স্ট্রিট -কিন্তু আপনি তো শ্রমিক না ² । বেমক্কা নোট বাতিল আর জি.এস.টি তে মাথায় হাত পড়েছিল দেশের ছোট-মাঝারি ব্যবসিক'দের, -কিন্তু আপনি তো আবার ব্যবসিক না ³ । আর আজকে যখন দলিত বিক্ষোভ উত্তাল মহারাষ্ট্র ⁴ তখন আপনি সিগারেটের ধোঁয়ার পিছনে দুটো ইংলিশ গুঁজে বলেছেন -"ডার্টি পলিটিক্স। দিস হোল ব্লাডি সিস্টেম ইস ক্র্যাপ।" বেসিক্যালি আপনি তো 'অ্যাপলেটিক্যাল'। মোটা দাগে আপনি 'নিরপেক্ষ'। আপনি তো আর 'দলিত' না!
ভাগ্যিস আপনি 'দলিত' না। হলে বুঝতেন, আজকের 'ডিজিটাল ইন্ডিয়া' কিম্বা আড়াইশো বছর আগের পেশোয়া'দের ব্রাহ্মণ্যবাদী মারাঠা সাম্রাজ্য -দলিতের নসীব বদলায়নি। পায়ের ছাপে আর থুতুতে পবিত্রতা নষ্ট হওয়ার ভয়ে দলিত'দের সেদিনও কোমরে ঝাঁটা আর গলায় কলসি বেঁধে 'ভদ্দর-লোকের' গ্রামে ঢুকতে হত ⁵। আর আজও খরা কবলিত মহারাষ্ট্রে 'উচ্চবর্ণ'র দুয়ারে জল আনতে গিয়ে দলিত বৌ'দের বেশ্যা বৃত্তি করতে হচ্ছে ⁶। ডিজিটাল দাদা। এক্কেবারে ষোলআনা ডিজিটাল।
সেদিন পেশোয়া'দের প্রবল সামাজিক বঞ্চনার ইতি টানতে ১৮১৮'র পয়লা জানুয়ারি ভীমা নদীর তিরে কোরেগাঁও'এ, ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদী'দের পক্ষ নিয়ে মুষ্টিমেয় কিছু দলিত মাহার যোদ্ধা বিশাল পেশোয়া সেনা কে পরাস্ত করে। ১৯২৭'এ আম্বেদকার, কোরেগাঁও'এ ব্রিটিশ'দের নির্মিত মহারা যোদ্ধা'দের শহীদ স্তম্ভে শ্রদ্ধা জানাবার পর প্রতি বছর দলিতরা কোরেগাঁও'এ পূর্বসূরি'দের বীরত্বের স্মরণে বিজয়োৎসব পালন করে ⁷। হিন্দু'দের অমরনাথ যাত্রা কিম্বা মুসলিম'দের হজের মতই; জলের কুমীর পেশোয়া'দের বিরুদ্ধে ডাঙ্গার বাঘ সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটিশ'দের পক্ষে যুদ্ধ জয়ে আদেও কোন গৌরব গাঁথা আছে কিনা সে বিতর্ক ব্যতিরেকেই দীর্ঘদিনের এই বিজয় সম্মেলন কে আগে কোনদিন উগ্র হিন্দুত্ববাদী'দের আক্রমণের মুখে পড়তে হয়নি ⁸। এবার হয়েছে। নেপথ্যে সঙ্ঘের আদর্শপুষ্ট সাম্বাজি ভিড়ে এবং মিলিন্দ একবোটে। পুলিশে অভিযোগ ও উপযুক্ত প্রামাণ্য নথি থাকলেও গ্রেপ্তার হননি কেউই ⁹। অবশ্য হওয়ার কথাও ছিল না। কারণ, ২০১৪'র নির্বাচনী প্রচারে নরেন্দ্র মোদী ভূয়সী প্রশংসা করেছিলেন সাম্বাজি ভিড়ে'র আর দেবেন্দ্র ফডনবিশের নির্বাচনী প্রচারে সফরসঙ্গী ছিলেন মিলিন্দ একবোটে। অতএব আমার গল্প ফুরল। নটে গাছটি মুড়ল¹⁰।
আসলে মোহন ভাগবত'দের রাম-রাজত্বে দলিত'দের উপর আক্রমণ সঙ্ঘ পরিবারের জাতপাতে বিভক্ত 'হিন্দুরাষ্ট্র' গড়ার আস্ত একটা 'মোডাস অপারেন্ডি'। এই সঙ্ঘ'রই মুখপত্র 'অরগানাইসার' সেদিন প্রবল জাতপাতবাদী 'মনুস্মৃতি'কে সংবিধানের গৃহীত খসড়াতে মান্যতা না দেওয়ায় তাবড় সম্পাদকীয় ছেপে গণপরিষদ কে তুলোধোনা করেছিল¹¹। এই সঙ্ঘেরই দ্বিতীয় সংঘচালক, বর্ণবাদী গোলওয়ালকার 'বাঞ্চ অফ থটসের' দশম অধ্যায়ে সগর্বে লিখেছেন, "জাতিভেদ প্রথা আসলে দেশের দুর্বলতা নয়, শক্তি ¹² ।" সেই ব্রাহ্মণ্যবাদী গোলওয়ালকার যার মতে নাকি, "শঙ্কর প্রজনন পদ্ধতিতে, প্রভূত লাভ হতে পারে মনুষ্য প্রজাতির। কেরলে নাম্বুদিরি ব্রাহ্মণ পরিবারের প্রথম সন্তান সব সময় নিম্নবর্ণের মেয়ের সাথে বিবাহ করবে এবং সন্তানের জন্ম দেবে। এইসব সন্তানেরা নাম্বুদিরি বামুনদের গুণাবলী তাদের পিতার থেকে পাবে। কেরলের যে কোনও জাতের, যে কোনও বিবাহিত মহিলা, তার বিবাহ অন্য যার সাথেই হোক, সেই মহিলার প্রথম সন্তান যেন নাম্বুদিরি বামুনদের ঔরসজাত হয় ¹³ ।" এমন গুণধর গুরুদেবের চ্যালা নরেন্দ্র মোদী যখন দেশের প্রধানমন্ত্রী তখন শুধু দলিত বলে পুলিশ'দের জুতো একটু চাটতে হবে বৈকি ¹⁴ ।
নরেন্দ্র মোদী সেই বিজেপি'র প্রধানমন্ত্রী, যে বিজেপির ২০১৪'র নির্বাচনী ইশতেহারে ফলাও করে লেখা হয়েছিল "দলিত'দের বি.পি.এল থেকে উত্তরণের জন্য সরকার কার্যকরী ভূমিকা নেবে। স্পেশাল ফান্ডের মাধ্যমে দলিত'দের সার্বিক উন্নয়ন নিশ্চিত করবে ¹⁵।" অথচ এন.সি.ডি.এইচ.আর'র তথ্যানুসারে স্পেশাল কম্পোনেন্ট প্ল্যানে দলিত'দের জনসংখ্যার অনুপাতে প্রস্তাবিত বরাদ্দ ১,৩৩,৬৬২ কোটি থেকে কমিয়ে ৮৪,৩১৩ কোটি করা হয়েছে। দেশজোড়া দলিত ছাত্র-ছাত্রী'দের স্কলারশিপ বাবদ বকেয়া বর্তমানে ১১,২৬৭ কোটি। লেখা হয়েছিল "মেথর'দের ময়লা পরিষ্কারের কাজ থেকে মুক্ত করে অস্পৃশ্যতা মুছে ফেলতে বিজেপি বদ্ধপরিকর। আর বাস্তবে, ২০১৭-১৮'র বাজেটে মেথর'দের পুনর্বাসনের বরাদ্দ বিজেপি সরকার ১০কোটি থেকে কমিয়ে অর্ধেক করেছে ¹⁶। অস্পৃশ্যতা মুছে ফেলা তো দুরস্ত, বিজেপির হার্টথ্রব ডোনাল্ড ট্রাম্পের দেশের গঠিত কমিশন বলছে গো-রক্ষা বাহিনীর বদান্যতায় দেশে দলিত'দের উপর আক্রমণ বেড়েছে ১৭% ¹⁷।
আপনি যখন নিরপেক্ষতা-নিরপেক্ষতা খেলছেন, তখন দলিত'দের ভাতে এবং পাতে মারার জন্য সামাজিক ও অর্থনৈতিক বঞ্চনার নতুন ইতিহাস লিখছেন মোদী-ভাগবত। সে আপনি যতই 'নিরপেক্ষ' আর 'বর্ণ ব্যবস্থা'য় আপনি যতই পৈতেধারী নিখাদ ব্রাহ্মণ কিম্বা দত্ত-ঘোষ-পাল-পুরকায়স্থ হন না কেন, এই 'আর্থিক ব্যবস্থায়' আপনিও ঐ 'দলিত'ই। সরকারী পরিকাঠামো এক্কেবারে নিচের সারিতে। যে সারিতে আপনার রেশনে চিনি আসে না। ফসলের ন্যায্য দাম জোটে না। নূন্যতম মজুরিতে হাত লাগে না। পি.এফ'র সুদ বাড়ে না। অর্থনীতির মার্কা মারা 'ট্রিকল ডাউন' থিওরি মেনে যে যাজকতন্ত্রে সরকারি সুযোগ সুবিধা থেকে আপনি বঞ্চিত, যে যাজকতন্ত্রে আপনি'ই 'অস্পৃশ্য', সেই যাজকতন্ত্রেরই এক্কেবারে শীর্ষে বসে আছেন আম্বানি-আদানি। যাদের জন্য কর্পোরেট ট্যাক্সে ছাড় আছে। এন.পি.এ'তে মাফ আছে। এফ.আর.ডি.আই'র আতিশয্য আছে। দেশে মদ বিক্রি করে বিদেশে পালানোর ব্যবস্থাও আছে। আর এদের পা চেটেই মুখের জেল্লা বেড়েছে নরেন্দ্র মোদী'দের। এদের "মালাই খেয়েই পেটে চর্বি জমেছে মোহন ভাগবত'দের"।
তাই জাতির-ধর্মের নামে মানুষ লেলিয়ে দেশ বিক্রি বন্ধ হওয়া অবধি এদের বিরুদ্ধে আমাদের জঙ্গ রহেগি। কৃষকের ফসলের দাম, শ্রমিকের ন্যায্য মজুরি, বেকারের পেটে ভাতের জন্য আমাদের জঙ্গ রহেগি। সঙ্ঘের বাই-প্রোডাক্ট বিজেপি'র আদর্শ কে ডাস্টবিনে ছুঁড়ে ফেলা অবধি জঙ্গ রহেগি। মোহন ভাগবত'দের পেটে জমা চর্বি গলা অবধি জঙ্গ রহেগি। নরেন্দ্র মোদীর'দের আম্বানি-আদানি'দের পা চাটা বন্ধ হওয়া অবধি জঙ্গ রহেগি। মিত্রোঁ, মেরি ক্রিসমাস তো তব হোয়েগি। হ্যাপি নিউ ইয়ার তো তব আয়েগি।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন