৩০'শে অগাস্ট আলিমুদ্দিন গিয়েছিলাম। ঐ প্রথমবার। খবরের কাগজে, টিভিতে তো প্রায়ই দেখি-শুনি, 'আলিমুদ্দিন চক্রান্ত করেছে', 'আলিমুদ্দিন ভয় পেয়েছে', 'আলিমুদ্দিন হিমশিম খাচ্ছে', 'আলিমুদ্দিনের কপালে ভাঁজ', 'আলিমুদ্দিন অমুক', 'আলিমুদ্দিন তমুক।' তাই অনেকদিনের সখ ছিল এই 'আলিমুদ্দিন' নামক 'নরকের দ্বার'টাকে একবার দেখবোই। বড্ড ম্যাড়ম্যাড়ে আলিমুদ্দিন, বুঝলেন। কোনও আড়ম্বর নেই। জৌলুস নেই। ঢোকার মুখটায় আলো নেই। ১৫ ফুট লম্বা ৫ হাত পুরু বিশাল প্রাচীর নেই। ব্ল্যাকক্যাট আর জেড ক্যাটাগরির সিকিউরিটি নেই। প্রায় নিশ্চিন্তেই, আপনি পৌঁছে যেতে পারেন একেবারে আলিমুদ্দিনের 'অলিন্দে'। সেই অলিন্দে, যেখানে সর্বদা আড়ি পেতে, নাড়ির খবর জোগাড় করেন আনন্দবাজার-বর্তমান এবং আরও অনেক শ্রী-মান। এমনকি আলিমুদ্দিনের উপরে যে লাল পতাকাটা, যেটাকে স্টার আনন্দের ফুটেজে ২৪X৭ পতপত করে উড়তে দেখেন, সেটাও হাওয়া না দিলে একবারে নেতিয়েই থাকে।
একটা বই'র জন্য অপেক্ষা করছি, টেবিলের অপর দিকে এসে বসলেন সাদা পাঞ্জাবি-পায়জামা পরিহিত এক ভদ্রলোক। লোকে বলে, বিমান বসু। একহাতে লাল চা'র গ্লাসে চা পাতা গুলো তখনও পাতনের নিয়মে থিতিয়ে পড়ছে, আর অন্য হাতে একটা ওষুধ। সৌজন্যের খাতিরেই জিজ্ঞাসা করলাম
-কিসের ওষুধ সুগারের? ভাবলাম বুড়োর বয়স তো হয়েছে সুগারের ঢিলটা নিশ্চয় লেগেই যাবে। ভদ্রলোক হেসে উত্তর দিলেন,
-৭০ থেকে দুধ-চিনি ছাড়াই চা খাচ্ছি। সুগার, প্রেশার আর কোলেস্টরেল কোনটাই আমার নেই। ঐ যে নবান্ন অভিযানের দিন মাথায় মারলো পুলিশ। ওষুধটা নেহাত সেই জন্যই।
ঠিকই তো। যে উচ্চবিত্ত ব্যবসায়ী পরিবারের ছেলে সুখ স্বাচ্ছন্দ্য ত্যাগ করে রাজনীতিতে এসেছেন, একসময় আদিবাসীদের সাথে ঘরে-দাওয়ায় চাটাই পেতে একপাতে ইঁদুর-পোড়া, ব্যাঙ-ভাজা খেয়েছেন, বিনিদ্র রাত কাটিয়েছেন, ছিয়াত্তরে যে বুড়ো গণতন্ত্র ফেরানোর দাবিতে তিনদিন অনশন করেন, ২১ কিলোমিটার হেটে কেশপুরের পার্টি অফিসে নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে পড়েন, তিনি যে চায়ে দুধ-চিনি কবেই ছেড়ে দেবেন, এতে আর আশ্চর্য কি। ভাবনাটা শেষ হবার আগেই উনি পকেট থেকে একটা বিড়ি বের করে ধরালেন। বামফ্রন্টের চেয়ারম্যান, সিপিআইএম'র পলিট ব্যুরো মেম্বার, এত বড় 'হার্মাদ' শেষে কিনা বিড়ি টানছেন? আমি তো টোটাল ট্যান। ভাবলাম, আচ্ছা পায়ে হাওয়াই চটি যদি 'সততার প্রতীক' হয় তাহলে, ঐ একই ত্রৈরাশিকে, হাতে বিড়ি ঠিক কিসের প্রতীক হওয়া উচিত? ঘড়ি ধরে ১৫ মিনিটের আলিমুদ্দিন অভিযান শেষে ফিরে আসার পথে ১০ সেকেন্ডের জন্য থমকে দাঁড়ালাম এক জায়গায়। 'ফিরে দেখা'র ডিকটেশন দিচ্ছেন এক ভদ্রলোক। গাল ভর্তি সাদা দাঁড়ি। আমি লেখালিখি করার চেষ্টা করি শুনে বললেন "লেখ। আমাদের যে ভুলের কথা গুলো কেউ লিখতে না, সেগুলোই সাহস করে লেখ।" আচ্ছা এই লোকটার "আমরা ২৩৬ ওরা ৩৬" মন্তব্যে মিডিয়া ঔদ্ধত্য'র মহাভারত লিখেছিল না? তাহলে বর্তমানে অন ক্যামেরা যিনি পুলিশ কে চাবকে পিঠের ছাল তুলে দেবার হুমকি দেন? সেটা কি তাঁর 'ঔদ্ধত্য' না জননেত্রীর মমতা?
পূর্বস্মৃতির বিলম্বিত অবতারণা নিতান্তই উদ্দেশ্য প্রণোদিত। গ্রেট কোলকাতা কিলিংস, তেভাগা, খাদ্য আন্দোলন, জরুরি অবস্থা, অপারেশন বর্গা আজ না হয় ওল্ড ফ্যাশানড। কনটেম্পোরারি বং' জেনারেশন না হয় সেসব হানি সিং ঢেলে আর সানি লিওনে গুলে খেয়েছেন। কিন্তু ঐ ভয়ঙ্কর ৩৪। কিম্বা এই স্বপ্নের পাঁচ। সেটা তো মডার্ন? তা এই ৩৯ বছরে, স্যামুয়েল ম্যাথুরা আলিমুদ্দিনের ভেতরে কিম্বা বুদ্ধ-বিমান বা ছোট-মাঝারি হার্মাদ গুলোর উপরে স্টিং অপারেশনের জন্য মাত্র ২৩ মিনিট খুঁজে পেলেন না? হোক না একটা স্টিং এঁদের উপরেও। ২৩ মিনিটের। যেকোনো ২৩ মিনিটের।
বছর সাত আগে, একটা স্টিং অপারেশনে, নন্দীগ্রামের সিপিআই'র প্রাক্তন বিধায়ক মহম্মদ ইলিয়াসের হাতে প্রায় জোর করেই গুঁজে দেওয়া হয় ১০,০০০ টাকা। বিধানসভায় জমা পড়ে সেই সিডি। স্বাধিকার ভঙ্গের নোটিশ আনেন আজকের এই 'পাঁচ লাখি' সৌগত রায়। স্বাধীন ও নিরপেক্ষ তদন্তের স্বার্থে পদত্যাগ করেন ইলিয়াস। আজ ইলিয়াস গুরুতর অসুস্থ। দু-বিঘা জমি বেঁচে তার চিকিৎসা চলছে। সংসার চলে বিধায়কের পেনশনে। আর সেই স্টিং অপারেশনর সাংবাদিক শঙ্কুদেব পণ্ডা ও তার পরামর্শ দাতা শুভেন্দু অধিকারী একবার 'সারদা' আর একবার 'নারদা'। ইলিয়াসের ছেলে আজ জানতে চায় সৌগত বাবু, আপনি কি স্বাধিকার ভঙ্গের নোটিশ আনবেন? করবেন ইলিয়াসের মত পদত্যাগ?
রথে চেপে দেশ ঘুরে 'মরেঙ্গে মর জায়েঙ্গে/ মন্দির ওহি বানায়েঙ্গে'র' চ্যাংড়ামি ও রাজনৈতিক আদর্শের জন্য আমি আডবানী কে অপছন্দ করি এবং বিশ্বাস করি হাওলা কাণ্ডে সিবিআই তদন্তও নিরপেক্ষ ছিল না। কিন্তু তবুও তদন্তের স্বার্থে লৌহপুরুষের অগ্রিম পদত্যাগের সিদ্ধান্ত শ্রদ্ধাযোগ্য। এরকম প্রতিটি রাজনৈতিক দলেই কিছু বিবেকবান, সৎ মানুষ আছেন। যারা আডবাণী-ইলিয়াসের সৎ সাহস ধরেন। বিমানের আত্মত্যাগ ধরেন। যারা পেটে গামছা বেঁধে নিঃস্বার্থে রাজনীতি করেন। রোদে পুড়ে, জলে ভিজে পার্টির ডাইরেক্টিভস অক্ষরে অক্ষরে মেনে চলেন। যাদের কোনদিন কোন স্টিং হয়নি। একটা ঘন্টাখানেক হয়নি। মিডিয়া ফুটেজ দেয়নি। সোশ্যাল মিডিয়া দেওয়ালে ঘুঁটে লেপেনি। এনারাই স্বচ্ছ রাজনীতির মুখ। এনারাই আমাদের আদর্শ। আমার ভরসা। আর যে রাজনীতি, যে রাজনৈতিক দল এদের অবজ্ঞা করে অবহেলা করে, ঐ ঘুষখোর ক্ষমতা লোভীদের দল চালানোর দায়িত্ব দেয়, নেতা-মন্ত্রী বানিয়ে মাথা তুলে নাচে, ফাঁদে পড়লে আঁচল দিয়ে আগলে রাখেন তাঁদের আমি ঘেন্না করি। আমার গর্ব, আমার অতিক্ষুদ্র সামর্থ্যে, আমি সেই রাজনীতির বিরুদ্ধেই লড়াই করি...
বুধবার, ১৬ মার্চ, ২০১৬
আলিমুদ্দিন ~ সুশোভন পাত্র
এতে সদস্যতা:
মন্তব্যগুলি পোস্ট করুন (Atom)
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন